বিয়ে মানেই সেই বাড়ির কোনো কোনায় ব্যস্ততা, কোনো কোনায় আমেজ, কোনো কোনে শোকের ছায়া। ঠিক তেমনই শৈলীর বাড়িতে চলছে আয়োজন। বাড়ির আদরের দুলালি, সকল সদস্যের প্রিয়, ভালোবাসার শৈলীর বিয়ে বলে কথা। চলুন ঘুরে আসা যাক প্রতিটি কোনায় কোনায়। দেখা যাক বিয়ের আগের দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কিছু দৃশ্য।

বিকেল তখন সাড়ে চারটা। শৈলীর দুই চাচাতো ভাই ব্যস্ত বাড়ির আলোকসজ্জা নিয়ে। এতোটাই ব্যস্ত যে দুপুরের খাবারটুকুও খায়নি তারা। এখন কি আর খিদেকে প্রশ্রয় দিলে চলবে! ওদের আদরের ছোট্ট বোনটি শৈলী। কাজিনদের মধ্যে সকলের ছোট সে। তার বিয়েতে পাত্র পক্ষকে কোনো প্রকার অভিযোগের সুযোগ দেবে না এই পন করেছে ভাইয়েরা মিলে। দু’জন এখানে ব্যস্ত রইলো আরো তিন জনের কথা, তারা গিয়েছে শৈলীর হলুদ সন্ধ্যার কারুকার্য খচিত বোর্ডটি আনতে। সেটি না এলে হলুদ সন্ধ্যার ডেকোরেশন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বিয়ের এক টুকরো আনন্দ।

শৈলীর মা চাচীরা ব্যস্ত রান্না ঘরের দিকে। হলুদ সন্ধ্যার পায়েস, ফল, কেক সেগুলো সাজাতে ব্যস্ত তারা। এরপর শুরু হবে ছুলে রাখা আদা, রসুন পেস্ট করার কাজ। পিষতে হবে বাদাম সহ আরো নানান মশলা। ইতিমধ্যেই পেঁয়াজ গুলো ছুলে রাখার কাজে ব্যস্ত শৈলীর ফুফু। কেটে রাখা যাবে না তাই ছুলে কাজ এগিয়ে রাখছেন আজই।

শৈলীর বাবা- ফুফা- চাচারা ব্যস্ত বিয়ের প্যান্ডেল নিয়ে। বরের আসন নিয়ে। এসবের মাঝে একমাত্র নিরব এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা শৈলী। সকলের ব্যস্ততা দেখছে সে। উপভোগ করছে ব্যস্ততার মাঝে সকলের ঠোটে লেগে থাকা সেই খুশিটুকুন।

___________
রাত তখন বারোটা বাইশ হলুদ পর্ব শেষে ঘরে বসে আছে শৈলী। গায়ে কাঁচা হলুদের গন্ধ মাখা হলেও হাতে পরা হয়নি মেহেদি। রাঙানো হয়নি ওই মানুষটার নামে নিজের হাতদুখানা। ঘুম এসে ভীড় জমিয়েছে চোখে। শৈলী ব্যস্ত নিজেকে জাগিয়ে রাখতে। মেহেদি পরবে সে। তার বোনেরা পারে সুন্দর মেহেদি পরাতে কিন্তু হবু শাশুড়ি মায়ের আদেশ তার পাঠানো মেহেদি, তার ঠিক করা আর্টিস্ট এবং তার ঠিক করে দেওয়া ডিজাইন চড়ানো হবে শৈলীর হাতে। যার মাঝে জ্বল জ্বল করবে তার একমাত্র পুত্রের নামখানা। এক মায়ের শখ বলে কথা, তাই তো শৈলি এখনো অপেক্ষা করছে সেই আর্টিস্ট এর। শৈলী শুনেছিল মেয়েটি বিকেলে আসবে কিন্তু হঠাৎ বিপদের সম্মুখীন হয়ে সময় চেয়ে নিয়েছে সে।

হবু শাশুড়ির আবদারের কথা ভাবতে ভাবতে অপেক্ষায় ডুবে থাকা শৈলীর কানে আসে একটা শব্দ। শব্দটা আসছে ওর ঘরের বেলকনি হতে। অলস ভঙ্গিতে হেঁটে যায় সেইদিকে। ঘুমুঘুমু চোখ দুটো যখন মেলে তাকায় তখন সামনে ভেসে ওঠে চেনা এক অবয়ব। যার দর্শন মাত্র ঘুম পালিয়ে যায় বহু মাইল দূরে। ভীত কণ্ঠে শুধায়,

“তুমি এখানে?”

কথা বলে না সেই ব্যক্তি। এগিয়ে আসে, দাঁড়ায় শৈলীর মুখোমুখি। ওর ডান হাতটা নিজের দিকে টেনে তাতে ছুঁইয়ে দেয় একটু খানি মেহেদি। যার দিকে নিবন্ধিত হয় শৈলীর স্থির দৃষ্টি। স্মৃতিরা ভীড় জমায়। তাদের মাঝে থেকে একটি দৃশ্য ঢেলে সামনে ভাসে শৈলীর মনে। মস্তিষ্কে গুঞ্জন তুলে কিছু বাক্য বার বার আসতে থাকে সামনে। ভাসতে থাকে মনে।

“আজ সবার আগে মেহেদি নিয়ে বসেছ ঠিক আছে কিন্তু আমাদের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন কনে শৈলীর হাতে প্রথম মেহেদি ছুঁয়ে দেব আমি।”

“সেদিন কেউ তোমাকে আমার কাছে আসতে দেবে?”

“দেবে না জানি। আমি লুকিয়ে আসব তোমার কাছে। শত বাধা পেরিয়ে শুধু তোমার হাতে মেহেদি ছোঁয়াতে আসব আমি। তুমি কিন্তু অপেক্ষা করবে আমার জন্য।”

স্মৃতির পাতা বন্ধ হতেই বন্ধ চোখের পাতা মেলে ধরলো শৈলী। শুনো কানের কাছে ফিসফিসে আওয়াজ,

“ভালোবাসি আমার শৈলী। বধূ বেশী শৈলীকে দেখার অপেক্ষায়।”

আশেপাশে চাইলো শৈলী। কেউ নেয় সেখানে। নজর বুলিয়ে দেখলো নিজের ডান হাত খানা। মেহেদি লেগে আছে সেই হাতে। যা দেখে চোখ ছাপিয়ে জল গড়ালো। বুকে হাতটা চেপে ধরে নিজেকে শুধালো,

“আমি কাঁদছি কেন? আমার তো কাঁদার কথা নয়।”

উত্তর মেলে না। তার আগেই কেউ ডাকে তাকে। মেহেদি আর্টিস্ট এসেছে তার ঘরে। সাথে আছে তার ফুফাতো বোন।

মেহেদি আর্টিস্টের হাতে শৈলীর বা হাত। খুব দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ উনি। ডিজাইন দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। এই হাতে ব্রাইড আঁকা হবে। সেটাই করছেন তিনি। একেকটা ডিটেইলস খুব সুন্দরভাবে ফুঁটে উঠছে তার কাজে। শৈলীর মনোযোগ ছিল সেই ডিজাইনে তখন তার ধ্যান আকর্ষণ করে নেয় আর্টিস্ট আপুর একটি কথা।

“ভাইয়া খুব ভালোবাসেন আপনাকে।”

শৈলী চমকে তাকায়। দেখতে পায় আর্টিস্ট আপুর মুখে হাসি হাসি ভাব। তিনি চোখ তুলে শৈলীকে দেখেন তারপর আবার কাজে লেগে পড়েন। কথা কিন্তু বন্ধ হয় না, চলতে থাকে।

“কিছু মনে করবেন না আপু। আপনার ব্যক্তিগত বিষয় এইভাবে বলছি বলে। আসলে ভাইয়াকে দেখেছি আমি ব্যালকনি থেকে যখন লাফ দিলেন সেই সময়। আমি তখন আপনার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

“কী বলছেন! আপুও তো ছিল সাথে। দেখে ফেলেনি তো!”

শৈলী আতঙ্কিত। বুঝতে পারে মেয়েটি। সে তাকে আস্বস্ত করে বলে দেয়।

“চিন্তা করবেন না। উনি দেখেননি কিছু। আমাকে রেখে উনি নিচে গিয়েছিলেন, কেউ ডেকেছিল উনাকে।”

“ওহ।”

“কালই তো বিয়ে তাই না?”

“উহু।”

“তাহলে!”

মেয়েটির কপালে ভাঁজ পড়ে। যা দেখে হাসে শৈলী। বলে,
“তারিখ পাল্টেছে আপু। সেই হিসেবে বিয়েটা আজ।”

এই কথার পরে দু’জনেই হেসে ওঠে। মেয়েটি বলে,
“কিছু ঘণ্টার বিষয়। ভাইয়া দেখছি আপনাকে চোখে হারাচ্ছেন।”

“হয়তো।”

আনমনে বলে ওঠে শৈলী৷ ডান হাতটা এগিয়ে দেখায় সে। মেহেদির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। বলে,
“ওর ইচ্ছে ছিল আমাদের বিয়ের মেহেদি সবার আগে ওই পরাবে। এই দেখুন ছুঁইয়ে দিয়ে গেল।”

“এ মা। আপু এইভাবে তো ডিজাইন নষ্ট হয়ে যাবে। কিছু মনে না করলে আমি এটা মুছে দিই। এইভাবেও ভাইয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েই গেছে।”

মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে হলো না। নিজেই এক টুকরো টিস্যু নিয়ে মেহেদিটুকু মুছে ফেলল শৈলী।

“মেহেদি ওয়ালা ভাইয়ার নাম কি আপু?”

“রক্তিম।”

“নামটা সুন্দর আপু।”

“ধন্যবাদ।”

______________
এখনো ডান হাত এবং উভয় হাতের উল্টো পিঠে মেহেদি লাগানো বাকি অথচ ওদের দু’জনের চোখেই ঘুম। শৈলীকে ঢুলুঢুলু করতে দেখে মেয়েটির মায়া হলো। সে তো আর ইচ্ছে করে এমন পরিস্থিতি বানায়নি। তার পরিবারের এক সদস্য হঠাৎ হসপিটালাইজড হওয়ায় জানিয়েছিল আসতে পারবে না, অন্য আর্টিস্টের ব্যবস্থা করে দেবে সে। কিন্তু ইমার্জেন্সি কেউই রাজি না হওয়ায় তাকেই আসতে হবে বুঝতে পেরে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিল সে। দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দিন পার করে রাত দশটায় গিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। এই যে এখন এই কাজটা শেষ হলে আবারও ছুঁটবে হসপিটালে।

“দুঃখিত আপু। আমার কথায় আমি অটল থাকতে পারিনি বলে আপনার ঘুম বিসর্জন দিতে হচ্ছে।”

“সমস্যা না। আপনি আপনার কাজ করুন।”

ডান হাতটায় মেহেদি চড়ানো শুরু করেছে মেয়েটি। ধীরে ধীরে রক্তিমের দেওয়া রঙটুকু ঢেকে গেল তার মাঝে। সেটা দেখে শৈলী বলল,

“একটা গল্প শুনবেন আপু? একটা প্রেমের গল্প। আমাদের গল্প। রক্তিম ও শৈলীর গল্প।”

মেয়েটি দেখে শৈলীকে। শৈলী একটুখানি হাসে তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে। অপেক্ষা করে না উত্তরের। শোনাতে শুরু করে গল্প। ওদের গল্প। ওর আর রক্তিমের গল্প।

_____________
রক্তিমের সাথে শৈলীর দেখা হয় ওর ফুফাতো বোনের শ্বশুর বাড়িতে। সম্পর্কে রক্তিম শৈলীর বোনের মামাতো দেওর। বউভাত অনুষ্ঠানে ভিড়ের মাঝে ধাক্কা লাগে ওদের। ছেলেটা ব্যস্ত ছিল, শৈলীকে না দেখেই স্যরি বলে দিয়ে চলে গিয়েছিল। ফিরেও চায়নি ওর দিকে। শৈলী ঠিক দেখতে কেমন সেটাও দেখেনি। কিন্তু শৈলী ওকে দেখেছিল। হ্যাংলা পাতলা ফর্সা দেখতে একটা ছেলে যার পরনের কাপড় ঘামে ভেজা, কপালে বিরক্তির রেখা। হয়তো ভাইয়ের বিয়েতে খেটেছিল খুব। কে জানে! জানার আগ্রহও দেখায়নি শৈলী। সেদিনকার মতো সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল গল্পের।

এরপর কয়েক মাস পরের কথা। ফুপির বাসায় দাওয়াত ছিল ওদের। সেখানে দেখা হয় আবার। শৈলী নিজের মতো সবার সাথে ব্যস্ত থাকে। তার সেই ব্যস্ততা ছিল কারো নজর কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেন না, শৈলী ব্যস্ত ছিল হাসিতে, মেতে ছিল গল্পে। তার সেই চোখের পলক ফেলা, অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করা আবার লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেওয়া। ভুল কিছু বলে ফেলায় চোখ ঢেকে নেওয়া আবার আঙুলের ফাঁক গলিয়ে সকলের মুখোভঙ্গি পরখ করা। ষোড়শীর সব কিছুই যেন কারো মনে ধরেছিল সেদিন। আর সেই কেওটা ছিল রক্তিম।

শৈলীর ফুপাতো বোনের কাছে জানতে চেয়েছিল, “মেয়েটা কে ভাবি?”

“কোন মেয়েটা?”

রক্তিম দেখিয়ে দেয় শৈলীকে। তারপর জানতে পারে শৈলী তার ভাবির কাজিন বোন। এইতো এই ছিল তাদের গল্পের পরবর্তী ধাপের আগের গল্প।

“আর তারপর?”

মেয়েটির কথায় স্মৃতিপুষ্কত বন্ধ হয়। ঘোর কাটে শৈলীর। বলে, “তারপর। তারপর প্রেম হয়েছিল। দু’জনে পাগলের মতো মজেছিলাম সেই প্রেমে।”

“তাই তো আজকের এই দিন।”

“উহু।”

“মানে?”

“আমরা সেই পাগল প্রেমিক-প্রেমিকা যেদিন ধরা খেলাম পরিবারের কাছে সেদিন দু’জনেরই পরিবার ছিল নারাজ। কেউই সম্পর্কটা মেনে নেয়নি।”

“তাহলে!

“আর কি পরিবারের মান ভাঙিয়ে লম্বা একটা সফর পার করে আজকের এই দিন।”

“বাহ! চমৎকার তো।”

“হু, চমৎকার বটে।”

হাসে শৈলী। আবারো ডুব দেয় সেই স্মৃতিপুস্তকে। পাতা উল্টে পৌছে যায় সেই দিন গুলোয় যেদিনগুলো কঠিন ছিল। যেন ক্ষরা ছিল ভূমিতে এরপর পরিবারের কিছু শীতল বাক্যের বর্ষণে কেটেছিল সেই ক্ষরা।

_____________
আমাদের প্রেমটা খুব সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছিলো। দু’জনে লুকিয়ে লুকিয়ে একে অপরের জন্য সময় বের কথা বলা। কখনো আপুর শ্বশুর বাড়ির দাওয়াতে লুকিয়ে একে অপরকে দেখা এইভাবে চলছিল। এরমাঝে একদিন হঠাৎ করে আমার ইচ্ছে হলো দেখা করব ওর সাথে। সেবার অনেকদিন দেখা হয়নি কিনা! তাই। রক্তিম রাজি ছিল না। কোনো মতেই ওকে রাজি করাতে পারছিলাম না জানেন। ও বললো শৈলী এইভাবে মিথ্যে বলে বাইরে দেখা করাটা খুব রিস্কের হয়ে যাবে। যদি কেউ জেনে যায়! তারচে বরং অপেক্ষা করি আমরা। সুযোগ আসবেই কখনো না কখনো।

আমি শুনলাম কিন্তু মানলাম না। জেদ ধরলাম, কাঁদলাম। আমার কান্নার সামনে ঝুঁকতে হয়েছিল ছেলেটাকে। সে এলো এবং আমাদের দেখা হবার কিছু পল, হয়তো পাঁচ মিনিটেরও কম সময় হবে; আমরা দেখলাম ওর বাবা দাঁড়িয়ে সামনে। ব্যস আর কী? জানাজানি হলো দুই বাড়িতে। রক্তিমের মা সবটা চাপিয়ে দিলেন আমার আপুর ঘাড়ে। বললেন আপু এসবের জন্য দায়ী। কথাটা ফুপি মেনে নিতে পারেননি। আর ফুপি থেকে বাবা, বাবা থেকে সমস্ত রাগ এসে পড়ে আমার উপর। পরিবারের সকলের আদরের এই আমি সেই দিনের সেই কয়েক ঘণ্টায় হয়ে গেলাম সবার থেকে দূরে।

_____________
“ভুলে যাও যা কিছু ছিল। তোমার আর ওই ছেলের মাঝে কিছুই হবার নয়।”

শৈলীর বাবা এই বাক্য আওড়ে বেরিয়ে গেলেন শৈলীর জন্য বরাদ্দ ঘর ছেড়ে। রইলেন ওর মা। মেয়ের মাথায় আলত হাত বুলিয়ে বললেন,

“ভুলে যা মা। সবকিছু একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা। তোর বাবাকে ভুল বুঝিস না। শুধুমাত্র তুই খুশি হবি বলেই উনি গিয়েছিলেন রক্তিমের বাবা মায়ের কাছে। ওরা তোর বাবাকে আর ফুপিকে যা নয় তা শুনিয়ে দিয়েছেন। আর এরপরে আবার তোর ফুপি ওনাকে শুনিয়ে গেল।”

শৈলী চুপ। ওকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললেন, “শোন আমার কথা, রক্তিম যদি তোকে চায় আমি নিজে তোর বাবাকে বোঝাব কিন্তু এখন নয়। বয়সটাই বা কত তোর? মাত্র ষোলো। এখন তোর পড়াশোনা করার বয়স। পড়াশোনায় মনোযোগী হ। তাড়াছাড়া ওরা বলছে এ তোর আবেগ মাত্র। তুই কিছুটা সময় নে। ভাব আসলে এটা কী? প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এসব সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটার মাঝে যেমন একে অপরের প্রতি যত্ন থাকে তেমনই থাকে সম্মান। দুইজন মানুষের একে অপরের জন্য সম্মান। তাদের পরিবারের একে অপরের প্রতি সম্মান। সেখানে তোর বাবা অসাম্মানিত হয়েই ফিরেছে। আবার যদি প্রয়োজন হয় তোর খুশির জন্য ঝুঁকতেও রাজি মানুষটা।
আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তোর দেখা এতোবছরের তোর বাবা ঠিক কেমন। তোর কথা ভেবে কি কি করতে পারে সেসব ভেবেই না হয় অপেক্ষা কর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রূপে আসুক। হু?”

শৈলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। এরপর কেটে যায় কয়েকটি মাস। হঠাৎ করে শৈলীদের দাওয়াত পড়ে ফুপাতো বোনের শ্বশুর বাড়িতে। শৈলী যেতে চায়নি কিন্তু যেতে বাধ্য হয়। সকলে যাচ্ছে ও যাবে না। এই নিয়ে অনেক তর্ক, মতবাদের পরেই ও তৈরি হয় যাওয়ার জন্য। গিয়ে সারপ্রাইজড হয়ে যায় ও।

_____________
মনমরা হয়ে একটা জায়গায় একা বসে শৈলী। তার পাশে এসে কেউ বসে। টের পেলেও কে বলেছে তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করে না মেয়েটা।

“কেমন আছো?”

পরিচিত গলা। ফিরে দেখে শৈলী। রক্তিমের মা বসে আছে তার পাশে। তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে সালাম জানায় তাকে। শৈলীর অবস্থা দেখে স্ফিত হাসেন তিনি। পরপর ওর হাত ধরে আবার পাশে বসিয়ে দেন কিন্তু হাতটা আর ছাড়েন না। অন্য হাতে থাকা একটা চিকন স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দেন তাকে। শৈলীর বিষ্ময় তখন সপ্তম আসমান ছুঁয়েছে। পরে অবশ্য জানতে পারে রক্তিমের জেদের কাছে হার মেনেই আজকের এই দিনে তারা একত্রিত হয়েছেন। এমনকি শৈলীর অগোচরে সপ্তাহ আগে তাদের একটা মিটিংও হয়েছিল। এসব জানার পরে শৈলী খোঁজে তার বাবাকে। দেখতেও পায়। পেয়ে দেখতে থাকে তাকে। আর দেখে বাবার খুশি খুশি মুখখান। যা তার সমস্ত দ্বিধা দূর করে দেয় নিমেষে। খুশি ছলকে পড়ে শৈলীর ঠোঁটে।

“তারপর?”

মেয়েটির কথায় আবারও স্মৃতি পুস্তক বন্ধ হয়। শৈলী চায় তার দিকে। বলে,

“সেদিনই আমি জনতে পারি রক্তিম দেশের বাইরে যাচ্ছে। আমার বয়স ষোলো বছর দশ মাস ছিল সেই সময়। সকলের মতে আমি ছোট তাই তখনি বিয়ের কথা ভাবেননি তারা। ঠিক হয় রক্তিম ফিরে এলে বিয়ে হবে আমাদের।”

“কখন ফিরলেন উনি?”

“এইতো মাস খানেক আগেই।”

কথা শেষ করে শৈলী খেয়াল করে ডান হাতের মেহেদি দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। আর সেই ডিজাইনের মাঝখানে বড় করে ইংরেজি অক্ষর ‘R’ জ্বলজ্বল করছে।”

শৈলীকে অপলক এক দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি হাসে একটুখানি। হেসে বলে,

“নামটা তো আমি জেনেছিই তাই আর আপনার গল্পের মাঝে হস্তক্ষেপ করিনি। নিজেই লিখে দিয়েছি। কেমন হয়েছে?”

“খুব সুন্দর। ঠিক যেমন আমি কল্পনায় নিজের হাতে ওর নামের অক্ষর দেখেছিলাম তেমন।

______________
মাঝখানে কাঁচা ফুলের পর্দা। একপাশে বর অন্যপাশে কনে। কাজি সাহেব বসে আছেন কনের সাইডে তার সামনে। তার হাতে থাকা কাবিননামা এগিয়ে দিলেন শৈলীর দিকে। শৈলীর ফুপাতো বোন সেটি হাতে নিয়ে বোনের হাতে তুলে দেয়। সাথে দেয় কলম খানা। বিয়ে পড়ানো শেষ হয়েছে ইতমধ্যে। এখন শুধু সাইনটুকু বাকি। সই করার আগে বরের নামের জায়গায় চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। সেখানে স্পষ্ট লিখা আছে একটি নাম। ‘অঙ্কন জোবায়ের।’
…..

শেয়ার করুন