কবুল বলার ঠিক একটু আগে কোথা থেকে কাব্য ভাইয়া পাগলের মতো দৌড়ে এসে বিয়ের ভরা আসরে আমার সামনে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

–‘তুই আমার অনাগত বাচ্চার মা হয়ে কিভাবে পারলি বিয়ের আসরে বসতে?’

সবাই কাব্য ভাই আর আমার মুখের উপর তাকিয়ে আছে৷ বিষ্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গিয়েছে৷ পাশে থেকে বাবা অবাক হয়ে কাব্য ভাইয়ার কাছে এসে নিচু স্বরে বলল,

–‘মানে,কি বলছিস কাব্য?’

–‘নীতু আমার বিয়ে করা বউ সাথে আমার অনাগত বাচ্চার মা৷’

কাব্য ভাইয়ের সোজাসাপ্টা কথা শুনে বাবা আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

–‘নীতু কাব্য যা বলছে তা সত্যি?’

বাবার কথায় মুখ তুলে কিছু বলবো সেই সাহস যোগাতে পারলাম না৷ লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে৷ কাব্য ভাই এতো বড় একটা মিথ্যা কথা কিভাবে বলতে পারলো৷ সে কি জানে না!তার এই কথার জন্য আমার বিয়েটা ভেংগে যাবে৷ কাব্য ভাই আমার সামনে এসে হাত ধরে উঠিয়ে বাবার সামনে নিয়ে বলল,

–‘ও কি বললে মামু,বলবে তো এই রিপোর্ট!’

আমার হাত ছেড়ে ফাইল থেকে রিপোর্ট বের করে বাবার হাতে দিয়ে মুখে লাজুক হাসি টেনে বলল,

–‘দেখো মামু তুমি নানাভাই হতে চলেছো!আর আমি বাবা৷’

বাবা রিপোর্ট দেখে সবার সামনে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিলো আমার গালে৷ আমি গালে হাত দিয়ে কান্না করে বললাম,

–‘বাবা,কাব্য ভাইয়া মিথ্যা কথা বলছেন! সত্যিই আমি কিছু জানি না৷ উনি মিথ্যা বলছে বিশ্বাস করো আমার কথা৷’

কাব্য ভাইয়া জিনিয়াকে ডেকে বলল,

–‘এই জিনিয়া আমি কি মিথ্যা বলছি? তুই তো আমাদের বিয়ের সাক্ষী৷’

জিনিয়া দুদিকে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলতেই আমি ওর দিকে রাগী চোখে তাকালাম৷ আমার বাবা আর কারো কথা না বিশ্বাস করলেও তার ছোট মেয়ের কথা অনায়াসে বিশ্বাস করে নিবে৷ মনে মনে আরেকটা চড় খাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই বাবা গম্ভীর মুখে বলল,

–‘আমি আর কিছু শুনতে চাই না৷ এই মূহুর্তে এই মেয়েকে নিয়ে আমার সামনে থেকে তুই চলে যাবি কাব্য৷ আজ থেকে আমার একটাই মেয়ে আর সেটা হচ্ছে জিনিয়া৷’

আমি কাব্য ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,’আপনার সাথে আমার কবে বিয়ে হয়েছে কাব্য ভাই?আর এই ভুয়া রিপোর্ট এনে সবার সামনে মিথ্যা বলছেন কেন?’

বাবা আর কাব্য ভাইয়াকে আমি জমের মতো ভয় পাই৷ আর আজ দুজন মানুষের সাথেই লড়তে হবে তাও কাব্য ভাইয়ার মিথ্যা নিয়ে৷ ভয়ে ভয়ে কাব্য ভাইয়া আর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে আবারও বললাম,

–‘প্রমাণ দিন কাব্য ভাই৷’

কাব্য ভাইয়া আবারও ফাইল থেকে কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,

–‘ছয় মাস আগে নিজে জোর করে আমাকে বিয়ে করে এখন প্রমাণ চাচ্ছিস নীতু?’

কাবিনের কাগজ যেখানে বড় বড় করে কনের জায়গায় “আফরা হুমায়রা নিতু”নামটা জ্বল জ্বল করছে আর সাইন টা আমার দেওয়া কিন্তু আমি তো এমন কোনো কাগজে সাইন করি নি৷আর বরের জায়গায় “কাব্য মেহরাজ”৷বাবা আমার কাছে থেকে পেপার টা নিয়ে চিল্লিয়ে বলল,

–‘আমার মান সম্মান আর কিছু ধুলোয় মিশানোর বাকি আছে তোর?এখুনি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা৷’

যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছিলো সে বাবাকে অনেক কিছু বলে বরযাএী সহ রাগে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমার সামনে এসে শাসিয়ে বলল,

–‘এইভাবে বিয়ের ভরা আসরে অপমান না করলেও পারতে নীতু তোমার এই অপমানের শোধ আমি নেব৷’

–‘শোধ নিন আর না নিন!আমার বউ আর অনাগত বাচ্চাকে নিয়ে আমায় যেতে দিন৷’ কাব্য ভাইয়ের গা জ্বালানো কথা শুনে “আমির” রেগে বেড়িয়ে যায়৷ কাব্য ভাই আমার হাত ধরে সবার সামনে দিয়ে নিয়ে আসে৷

__________________________

গাড়িতে বসে কান্না করে যাচ্ছি আমি৷ আর কাব্য ভাই ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন৷ আমার জীবন তচনচ করে দিয়ে আবার গানও শুনছেন তিনি৷ আমি যে পাশে বসে আছি এইদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ আমি জোরে জোরে কান্না করতে করতে বললাম,

–‘আপনি এতো বড় মিথ্যা না বললেও পারতেন কাব্য ভাই৷ আপনার জন্য আজ বাবা সবার কাছে অপমানিত হয়েছে৷ আমাকে সবাই নিচু চোখে দেখছে৷ আপনি এমন মিথ্যা কেন বললেন৷ আমি কি ক্ষতি করেছি আপনার?’

কাব্য ভাইয়া গানের সাউন্ড আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

–‘কিছু কি বলছিস তুই?আরো জোরে বল, আমি শুনতে পাচ্ছি না৷’

তার এমন আচরণ দেখে রেগে গান বন্ধ করে চিল্লিয়ে বললাম,

–‘আপনার কোনো কমনসেন্স আছে?আপনি এমনটা কেন করলেন৷ বাবার চোখে আমায় অপরাধী বানিয়ে দিয়ে এখন ফাজলামি করছেন আমার সাথে? আপনি আমার জীবন টা শেষ করে দিয়েছেন৷’

কাব্য ভাইয়া উত্তর না দিয়ে জোরে ব্রেক করলেন৷ সাহস নিয়ে কথা বলার পর এখন তার দিকে মুখ তুলে তাকাতে সাহস হচ্ছে না আমার৷ অনেকক্ষণ তার সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সে গাড়িতে নেই৷ আশেপাশের তাকাতে দেখি তাদের বাসায় এসে পড়েছি৷ আর সে বাড়ির ভেতর ঢুকছে৷ পিছন ফিরে আমার উদ্দেশ্য বললেন,

–‘বাড়িতে ঢুকতে চাইলে গাড়ি থেকে নেম আয়৷ আর যদি গাড়িতে থাকতে চাস তাহলে গাড়ির লক টা আটকে দিস ভালো মতো৷ বলা তো যায় না চোর টোর এসে তোকে সহ আমার গাড়ি নিয়ে যাবে৷ তোকে নিলে কোনো সমস্যা নেই৷ তবে এইটা আব্বুর গাড়ি বুঝিস’ই তো এতো দামী গাড়ি চুরি হলে আমার বাপ নিশ্চয় হার্ট অ্যাটাক করবে৷’

তার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি নিজে উনার সাথে জোর করে এসেছি৷ ইচ্ছা হচ্ছে কিছু একটা দিয়ে উনার মাথা ফাটিয়ে দিই৷গা ছাড়া ভাব করছে এখন এতো বড় মিথ্যা বলে৷ আমি জোরে গাড়ির দরজা ধাক্কা মেরে খুলে নেমে পড়ি৷ উনি এতোক্ষণে গেটের কাছে পৌছে গিয়েছেন৷ আমি উনার পাশে দাড়াতেই কলিং বেল চাপলেন উনি৷ কিছুক্ষণ দাড়াতেই দরজা খুলে দিতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি…………


–‘আম্মু তোমার বউমা আর অনাগত নাতি নাতনি কে নিয়ে এসেছি।’

কাব্য ভাইয়ের কথা শুনে ফুপি তার গালে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন। কাব্য ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে গালে হাত দিয়ে ফুপির দিকে তাকিয়ে আছে। ফুপি রেগে বললেন,

–‘তোর সাহস কি করে হয় আমাকে আগে না জানানোর?ফাজিল ছেলে যা ইচ্ছা তাই করিস তুই৷ আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা এখুনি৷’

কাব্য ভাইয়া ফুপির হাত ধরে ইনোসেন্ট ভাবে বললেন,

–‘আম্মু সিরিয়াসলি বলছি,আমার কোনো দোষ নেই৷ প্লিজ ক্ষমা করে দাও৷’

ফুপি আমার দিকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকাতে আমি তার পাশে গিয়ে বলি,

–‘ফুপি বিশ্বাস করো! তোমার ছেলে মি…..

–‘হ্যাঁ!হ্যাঁ আম্মু সবাইকে মিষ্টি পাঠিয়ে দিবে তুই চিন্তা করিস না৷ আম্মু ওকে রুমে নিয়ে যাও ওর অনেক ক্ষিদে পেয়েছে গাড়িতে বললো৷’

কাব্য ভাই আমার কথার মাঝে থামিয়ে সুন্দর করে আরো মিথ্যা বলে দিলো৷ ফুপিও তার ছেলের কথা শুনে মহা আনন্দে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো৷ সবাই কাব্য ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করছে কি করে?কেও আমার কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করেছেই না৷ শাড়ি আর গয়নার ভারে আমার অবস্থা নাজেহাল৷ ফুপি আমাকে একগাদা কুর্তি আর সালোয়ার কামিজ দিয়ে ফ্রেশ হতে বলে চলে গেলেন৷ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই সব গুলো কাপড় আমাকে বাবা নিজে বিয়ের আগে কিনে দিয়েছিলো৷ আজ পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা আমার সাথেই ঘটছে মনে হচ্ছে৷

কাব্য ভাইয়ের পাশের রুমে আমাকে ফুপি রেখে গেছে৷ বিয়ের আগে এই বাসায় বেড়াতে আসলে এই রুমটা আমার জন্য বরাদ্দ থাকতো। বেডের সাইডে টেবিলে তাকিয়ে আমি আবারো অবাক হয়ে যাই৷ সেখানে আমার অনার্সের সমস্ত বই৷ বই গুলো আমি আমার বাড়ির টেবিলে রেখে দিয়েছিলাম বিয়ের পর নিয়ে যাবো বলে৷ নিশ্চয়ই আমি সপ্ন দেখছি৷ নিজের হাতে নিজেই চিমটি কেটে পরখ করতেই ব্যাথায় কুকড়ে উঠলাম৷ হাত পা ছড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদার তীব্র ইচ্ছা হতেই ডাইনিং রুম থেকে ফুপি আমাকে খাওয়ার জন্য ডাকছে শুনতে পেলাম৷

বাড়িতে আজ ফুপি কাব্য ভাইয়া আর আমি ছাড়া কেও নেই৷ আঙ্কেল ব্যাবসার কাজে ঢাকা গিয়েছে আর কবিতা আপু শশুর বাড়ি৷ কাব্য ভাই আমার সামনে বসে আরামসে গরুর হাড় চিবোচ্ছে৷ ডাইনিং টেবিলে আমি নামক একটা মানুষ আছে সে দিকে তার কোনো দ্রুক্ষেপ নেই৷ ফুপি আমার পাশে বসে খাচ্ছে আর গল্প করছে৷ তাদের কারো কোনো হেলদোল নেই এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো৷ আমি ইচ্ছা করে পানির গ্লাস জোরে রাখতে কাব্য ভাইয়া একবার তাকিয়ে ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–‘আম্মু, তোমার ভাইয়ের মেয়েকে বলো ঠাস করে গ্লাস না রাখতে৷ ভেঙে গেলে এর টাকা দিবে কে?’

ফুপি রাগ দেখিয়ে বললেন,

–‘ওর পিছে না লাগলে হয় না তোর? খেতে এসেছিস চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যা৷এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো তাতে ওর কোনো আক্ষেপ’ই নেই৷’

ফুপির কথা শুনে আবেগে কান্না পেয়ে গেলো আমার৷ হু হু করে কেদে উঠে বললাম,

–‘ফুপি একমাএ তুমি’ই বুঝতে পেরেছ৷ কত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো কেও কোনো কিছুই বলছে না৷ আর উনি গা ছাড়া ভাব করে আছে৷’

ফুপি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,

–‘তুই জানিস ঘটনা? তোকে কাব্য বলেছে?’

কাব্য ভাইয়া চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে আরেকটুকরো মাংস উঠিয়ে মুখে পুড়ে বললেন,

–‘আম্মু তোমার সিরিয়ালের সময় হয়ে গেছে৷’

আমি আর কিছু বলবো তার আগেই ফুপি উঠে যেতে যেতে বলল,

–‘নীতু আম্মু কাদিস না৷ ঘটনা আমি পরে শুনবো এখন আয় আমার সাথে সিরিয়াল দেখবি৷’

ফুপি মনোযোগ সহকারে সিরিয়াল দেখছে৷ আজ সব কিছু বিরক্তি লাগছে৷ ফোন টাও সঙ্গে আনি নি৷ এইবার অনার্স প্রথম বর্ষে উঠেছি আমি৷ আর কাব্য ভাইয়া হাইয়ার স্টাডিজ-এর জন্য জার্মান যাওয়ার ট্রায় করছেন৷ উনার সম্পর্কে আমার ধারণা একটুও নেই বললেই চলে৷ সাদা রঙের সুঠাম দেহের একজন সাদা ভাল্লুক ও বলা যায়৷ ক্রাশ খাওয়ার মতো সম্পর্ক তার সাথে আমার কোনো কালেই ছিলো না৷ তাকে দেখে দূরে দূরে থাকাই একমাএ লক্ষ্য ছিলো আমার৷ এই ব্যাটা যেখানে সেখানে আমার বাশ দিতে পিছপা হয় না৷ আজকের ঘটনা নিসন্দেহে আমাকে ফাসানোর জন্য তার প্ল্যান মনে হচ্ছে আমার৷ অসহ্য লোক একটা৷

–‘আমায় বকা দেওয়া শেষ হলে এখান থেকে উঠে ঘরে চলে যা৷ আম্মুর সাথে পারসোনাল কথা আছে আমার৷’

ভাবনার মাঝেই তার অপমান জনক কথা শুনে রেগে উঠে চলে আসতেই ফুপি বললেন,

–‘ওর সামনে আবার কিসের পারসোনাল কাব্য?নীতু যেভাবে বসে ছিলি সেইভাবেই বসে থাক৷ এক পা ও নড়বি না তুই৷’

আমি শান্ত কন্ঠে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম,

–‘আমার ঘুম পেয়েছে ফুপি৷ উনার পারসোনাল কথা নিয়ে উনি থাক৷ কারো কথায় বা বিয়েতে ইন্টারফেয়ার করা আমার স্বভাবের মধ্যে পড়ে না৷’

রাগে কান্না পাচ্ছে আমার৷ সব কিছু এলোমেলো লাগছে৷ আমার সাথে হচ্ছেটা কি আজ?

___________________________________

দেয়ালে থাকা ঘড়ির টিক টিক আওয়াজে তাকিয়ে দেখি রাত ১ঃ৩০ বাজে৷ আমার চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না৷ বাইরে বোধহয় মেঘ সেজেছে হালকা ঠান্ডা বাতাস জানালার পর্দা ভেদ করে আমার শরীরে এসে লাগছে৷ মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের বেড়াজালে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে৷ সবাই অস্বাভাবিক হয়েও স্বাভাবিক৷ অস্থির পায়ে হেটে বেড়াচ্ছি ঘরের সমস্ত জায়গা৷ হটাৎ গিটারের টু টাং আওয়াজে ভয় পেয়ে যাই৷ কাব্য ভাইয়ের গিটার আছে মনে পড়তেই স্বস্তি পাই৷ আমার রুমের লাগোয়া বারান্দায় থেকে আসছে মনে হচ্ছে আওয়াজ টা৷ ধীরপায়ে এগিয়ে যেতেই দেখি কেও নেই৷ এমনিতেই টেনশনে মরে যাচ্ছি তার উপর ভয়৷ আবারও আওয়াজ আসতেই কেপে উঠি৷ সাহস করে আশেপাশে তাকাতে দেখি কাব্য ভাইয়ার বারান্দা থেকে আওয়াজ আসছে৷ রাতের গভীরে শব্দ দূরে হলেও মনে হয় ঘরের বাইরে হচ্ছে৷ বাইরে থেকে আলো আসায় দেখতে পেলাম কাব্য ছাই রঙের টি শার্ট পড়ে গিটার হাতে বসে আছে৷ তার দৃষ্টি বাইরে কিছু একটা গভীর মনযোগ দিয়ে ভাবছেন উনি৷ আমার ঘুম হারাম করে উনি গিটার বাজাচ্ছেন মনের সুখে৷ আমার বারান্দায় থেকে উনার বারান্দায় যাওয়া যায় অনায়াসে৷ আমি দেয়াল টপকে দাড়াতেই ধপ করে শব্দ হলো৷ আমার উপস্থিতি দেখে উনার কোনো হেলদোল হলো না৷ উনায় দেখে মনে হচ্ছে উনি জানতেন আমি আসবো৷ আমি রেগে তাকে বললাম,

–‘এইসব কি হচ্ছে কাব্য ভাইয়া?’

উনি ভাবেলাশীন ভাবে গিটারে আওয়াজ তুলে বললেন,

–‘কোথায় কি হচ্ছে!’

আমি তেতে উঠে বললাম,

–‘আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?এইজন্য এই মিথ্যা নাটক?’

উনি নীরব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হুট করে উঠে একদম আমার মুখের সামনে উনার মুখ এনে দাড়ালেন৷ আমি পিছিয়ে যেতেই আবার আমার দিকে ঝুকে……….


কাব্য ভাইয়া এখনো আমার মুখের উপর ঝুকে আছে৷ উনার গরম নিশ্বাস আমার চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে৷ প্রায় পাঁচ মিনিট হতে চললো সে এক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ করছি৷ নিশ্চয়ই আমায় উঠিয়ে বারান্দা থেকে ফেলে দিবে৷চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার পিছনে থাকা ঝুলন্ত মানি প্লান্ট গাছের ডাল অন্য গাছ থেকে ছাড়াচ্ছেন৷ হাসবো না কাঁদবো আমি? ছিঃ!নিজের মন কে ধিক্কার জানাই৷ কতো কিছু ভেবে বসে ছিলাম৷ কাব্য ভাইয়া এতোটা কাছে কোনোদিন আসে নি৷ তার শরীর থেকে সুন্দর মন মাতানো সৌরভ ভেসে আসছে৷ বাইরে থেকে আসা হাওয়ায় তার চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে৷ সাদা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো না থাকলে উনায় নির্ঘাত মেয়ে মেয়ে লাগতো৷ ভেবেই আনমনে হেসে উঠলাম আমি৷ আর উনি ভ্রুকুটি করে নিজের মহান কাজ ছেড়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–‘এখনো যাসনি তুই এখান থেকে? অন্যের ঘরের আসতে লজ্জা করে এতো রাতে তোর!ওই সময় তো খুব পারসোনালিটি দেখাচ্ছিলি৷’

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস নিয়ে বললাম,

–‘আপনি আমাকে বিয়ে করেননি কাব্য ভাই!তাহলে মিথ্যা কেন বললেন?আর এইসব হচ্ছেটা কি? আপনি কি আমায় ভালোবাসেন তাই জন্য এই মিথ্যা নাটক?’

উনি আমার সামনে থেকে সরে চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

–‘দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি!যে আমি তোকে ভালোবাসতে যাবো৷’

–‘তাহলে সন্ধ্যা সময় ওইসব কি ছিলো?’

–‘কোন সব?’

আমি রেগে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,

–‘একদন না বোঝার ভাণ করে থাকবেন না কাব্য ভাই৷ কোন সব প্রশ্ন করছেন,আপনি নিজে এতো কিছু করে এখন কোন সব জিজ্ঞেস করছেন৷’

উনি নিরুত্তাপ ভাবে হাই তুলতে তুলতে বললেন,

–‘নীতু তুই মেইবি পাগল হয়ে যাচ্ছিস৷ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়৷ আর একটা কথা বললে তোকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দিবো৷’

রাগে আমার কান্না পাচ্ছে৷ আমি কান্না করতে করতে উনায় বললাম,

–‘দেখুন কাব্য ভাইয়া!আপনার সাথে আমার কোনো শএুতা নেই৷ এমন কেন করছেন আপনি?সমস্ত সত্যিটা বাবাকে বলে দিন আমি বাসায় যাবো৷’

কাব্য ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে রুমে যেতে যেতে বললেন,

–‘আমি কারো চাকর নই যে বলতে যাবো৷ যা হচ্ছে হতে দে এতে তোর’ই ভালো৷’

আমি আর কিছু বলতে যাবো উনি ঠাস করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে বললেন,

–‘রাত দুটো বাজতে আর দুই মিনিট বাকি৷ উপরের ফ্ল্যাটের বিষ খেয়ে মরে যাওয়া মেয়েটার ভুত এসে ঘুরঘুর করবে৷ আর যাকে পায় তার উপর ভর করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য৷ ভুতের হাতে পড়তে না চাইলে দৌড় দে৷’

উনার কথা শুনে আমার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো৷ সত্যিই কিছুদিন আগে উপরের ফ্ল্যাটের মিমি আপু বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ ভুতে এমনি ভয় পাই তার উপর তো প্রেতাত্মা৷ হঠাৎ কেমন ভারী কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি ভয়ে ভয়ে দেয়াল টপকে নিজের রুমের দিকে দৌড় দিই৷ অকালে ভুতের খপ্পরে পড়ে নিজের জীবন দিবো নাকি তাও এই কাব্য ভাইয়ার জন্য৷ রুমে এসে চাঁদর মুড়ি দিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছি৷ উনি কতোটা খারাপ আমায় ভুতের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো!


জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের রোদ চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় আমার৷ বাইরে উচ্চ স্বরে কাক ডেকে চলেছে৷ বিছানা থেকে উঠতে একদম ইচ্ছা হচ্ছে না৷ কাল রাত দুটোর পর ঘুমানোর জন্য মাথার ভেতর চিনচিনে ব্যাথার অনুভব হচ্ছে৷ ঘড়ির দিকে অলস ভাবে তাকিয়ে দেখি ১০ঃ৪৪ বাজে৷ মাথা চেপে উঠে বসে কালকের ঘটনা ভাবি৷ আজ ভুতের ভয় নেই!কাব্য ভাইকে তো আজ আমার প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে। ধীরপায়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখি কাব্য ভাই সোফায় বসে মোবাইল টিপছে৷ আর ফুপি রান্নাঘরে!আমি উনার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম,

–‘আমার কথার উত্তর না দিলে আপনার নামে কেইস করবো আমি৷’

–‘কারণ?’উনি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন৷ থমথমে কন্ঠ শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার৷ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,

–‘এই যে আপনি আমাকে বিয়ের আসর থেকে মিথ্যা বলে উঠিয়ে এনেছেন৷ এইটার চেয়ে আর বড় কোনো কারণ আছে কি? আমার অমতে যেহেতু হয়েছে তাই এইটাই বড় কারণ৷’

উনি মোবাইল রেখে গালে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

–‘পুলিশের কাছে যাবি যা আমার প্রব্লেম নেই৷ তবে আমার মামু কে জেলের ভাত খাওয়াতে চাইলে যেতেই পারিস৷’

–‘মানে?’

–‘আঠারো বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া আইনী দণ্ডনীয় অপরাধ জানিস তো?’

আমি দ্রু কুচকে বললাম,

–‘আপনার কি মনে হয়, আমার আঠারো বছর হয় নি?’

উনি টি টেবিল থেকে পানির গ্লাসে পানি ঢেলে বললেন,

–‘হ্যাঁ,সতেরো বছর দুইমাসের শিশুর দুইদিনে আঠারো বছর হয়ে গেলো?’

–‘আমার উনিশ বছর দুইমাস চলছে৷’

কাব্য ভাইয়া আমার কথা শুনে সদ্য পান করা পানি কেশে উঠে মুখে থেকে ছিটকে পড়ে যায় । তার নাকে মুখে পানি উঠে গেছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে কেঁশেই চলেছেন৷ আমি উনার মাথায় হাত দিতেই আমার হাত সরিয়ে কাশতে কাশতে বললেন,

–‘তুই বেশি জানিস আমার চেয়ে? তুই হওয়ার সময় তুই কি দেখেছিলি কবে হয়েছিস তুই!’

–‘তাহলে কি আপনি দেখেছিলেন?ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি অনার্সে পড়ি কাব্য ভাই৷ কোনো সতেরো বছরের মেয়েকে দেখেছেন অনার্সে পড়তে?’

উনি মোবাইল হাতে নিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে কিছু একটা করছেন৷ আমি সিরিয়াস হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি৷ উনার কথা সত্যি এইটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে উনার মুখের সিরিয়াস ভাব দেখে৷ উনি হঠাৎ বসা থেকে উঠে চিল্লিয়ে বললেন,

–‘আম্মু,আমি বাইরে যাচ্ছি! ফির‍তে দেরে হতে পারে৷’

ফুপি রান্নাঘর থেকে বললেন,

–‘কাব্য বাইরে যাবি না তুই এখন!লান্স করে তারপর বের হবি৷’

ফুপির কথা তোয়াক্কা করে কাব্য ভাইয়া এতোক্ষণে দরজার বাইরে বেরিয়ে গিয়েছেন৷ আমি বোকার মতো উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি৷ আমায় বোকা বানিয়ে আবারও চলে গেছেন তিনি৷ এতশত রহস্য আমার বিরক্ত লাগছে৷ কবে পাবো সব প্রাশ্নের উত্তর?

জিনিয়া আমার পিছে পিছে ঘুরছে এক ঘন্টা যাবৎ৷ কাব্য ভাইয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ও এসে হাজির হয়েছে৷ আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু আমি ওর সাথে কথা বলবো না৷ ও কি করে পারলো মিথ্যা বলতে? আমি রুমে ঢোকার পর দরজা বন্ধ করতে যাবো তার আগে ও বলল,

–‘আপু তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিবো!তাও প্লিজ আমার সাথে কথা বল৷ তোর সাথে কথা না বলতে পেরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে৷তোর যা জানার আছে আমি সব সব বলবো তোকে৷’

ওর কথা শুনে ওকে ভেতরে আসতে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি৷ ও আমার পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

–‘আপু কথা বলবি না আমার সাথে?’

আমি তেতে উঠে বললাম,

–‘তোর সাথে কথা বলার স্কোপ রেখেছিস তুই?এতো বড় একটা মিথ্যা কেন বললি তুই! তুই কবে আমার আর কাব্য ভাইয়ের বিয়ের সাক্ষী ছিলি৷ বল!’

–‘তুই রাগ করবি না তো৷’

সব কিছু শেষ করে এখন আসছে আমায় জিজ্ঞেস করতে৷ ইচ্ছা হচ্ছে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিই৷ আমি নিজেকে সামলিয়ে বললাম,

–‘আমি তো মানুষ না তাই আমার রাগ নেই৷ তুই বল,কিন্তু সব সত্যি তুই আমার কাছে বলে বাবাকেও বলবি বুজেছিস?’

জিনিয়া দুদিকে মাথা দুলিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে একটা মোবাইল বের করে বলে…………

বারান্দায় রাখা বেতের দোলনায় বসে আছি মাথায় হাত দিয়ে৷ জিনিয়া আমার পাশে কাচুমাচু করে বসে আছে৷ ওর হাতে কাব্য ভাইয়ের দেওয়া আইফোন টুয়েলভ৷ এই মোবাইলের বিনিময়ে আমার একমাএ বোন মিথ্যা জালে আমায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে৷ রাগে আমার শরীর কাঁপছে!আমি ওর সামনে দাঁড়িয়ে জোরে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে হাফ ছাড়লাম৷ ইচ্ছা হচ্ছে আরো কয়েকটা থাপ্পড় ওর গালে লাগিয়ে দেই৷ জিনিয়া ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,

–‘তু….তুই আ…মায় মারতে পারলি আপু?’

আমি ওর আরেক গালে থাপ্পড় দিয়ে বললাম,

–‘তোকে আমার খুন করতে ইচ্ছা হচ্ছে জানিস!এতো বড় লোভী কেন তুই?সামান্য একটা ফোনের জন্য তুই বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে কাব্য ভাইয়ের কথায় তাল মেলাতে পারলি৷ আর বাবা,সেও তোর কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে!তুই সেটা জেনেও তোর বোনের জীবন দোটানায় মিথ্যার বেড়াজালে জড়াবি?’

কান্না করতে করতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে ও৷ গালের হাত সরাতেই দেখি পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেছে৷ বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যাথা হলো ওর কান্নামাখা মুখ টা দেখে৷ ওর যখন ছয় বছর তখন মা হঠাৎ করে আমাদের ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে যায়৷ আর আমার তখন নয় বছর৷ বাবা আমাদের কষ্ট হবে দেখে বিয়ে করে নি৷ সেই ছয় বছরের জিনিয়াকে আমি আগলে আগলে রাখতাম সব সময় ৷ কিন্তু ও ভুল করেছে৷ যা ক্ষমার যোগ্য না৷ আমি ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললাম,

–‘কাব্য ভাইয়া তোকে কি বলেছিলো!সব বলবি, নাহলে আবার থাপ্পড় মারবো তোকে৷ ফাজিল মেয়ে!’

–‘কিছুই বলে নি,শুধু বলেছিলো তুই নীতুর বিয়ের দিন আমি যা বলবো তাতে হ্যাঁ বলবি৷ আমি কারণ জিজ্ঞাসা করতে ভাইয়া বলেছিলো,এই ছেলের সাথে তোর বিয়ে হলে নাকি অনেক বড় সমস্যা হবে৷ বিশ্বাস কর আপু আমি মানা করেছিলাম বাট তোর সমস্যা হবে শুনে রাজি হয়ে গিয়েছি৷’

আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বললাম,

–‘তোর ফোন আমার কাছে দিয়ে যাবি তুই৷ আর একটাও কথা বলবি না৷ আমার রাগ পড়ে গেলে তোর সাথে কথা বলবো৷ যদি এই বাড়িতে থাকতে চাস তবে থাক আর না হলে বাসায় চলে যাবি এখুনি৷’

–‘জিনিয়া কোথাও যাবে না৷ ও ওর ফুপির বাসায় এসেছে ওকে চলে যাওয়ার বলার তুই কে?’

কোথা থেকে কাব্য ভাই এসে বললেন কথাটা৷ আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন৷ জিনিয়া কাব্য ভাইয়া কে দেখেই জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে৷ কাব্য ভাইয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

–‘কি হয়েছে জিনিয়া রাণীর?ওর কথায় কষ্ট পেয়েছো?’

–‘ভাইয়া,তুমি মোবাইল দিয়েছ দেখে আপু আমায় মেরেছে৷’

জিনিয়ার কথা শুনে রাগ আবার মাথা চারা দিয়ে উঠলো আমার৷ ওকে কাব্য ভাইয়ের কাছে থেকে ছাড়িয়ে হাতে থেকে মোবাইল নিয়ে কাব্য ভাইয়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে বললাম,

–‘আপনি অনেক খারাপ কাব্য ভাই৷ যাকে বলে নির্লজ্জ!আপনার সাহস কি করে হলো এমন করার?আপনার হাতের পুতুল আমি৷ যে ভাবে নাচাবেন সেই ভাবে নাঁচবো ভেবেছেন?’

কাব্য ভাইয়া আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে জিনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–‘জিনিয়া তুই ড্রয়িং রুমে আম্মুর কাছে যা৷ যাওয়ার আগে মোবাইলটা উঠিয়ে নিয়ে যাস৷ আর ভুলেও আম্মুকে কিছু বলবি না কেমন?আর বললে তোকে ল্যাপটপ কিনে দিবো না৷’

জিনিয়া মোবাইল উঠিয়ে চোখ মুছে চলে যেতেই কাব্য ভাই হাত গুজে দাঁড়িয়ে বললেন,

–‘এইবার শুরু কর৷’

–‘বিয়ে নামক পবিএ সম্পর্ক নিয়ে আপনি মিথ্যা বলেছেন কেন৷’

–‘তারপর?’

উনার গা ছাড়া ভাব দেখে আমি রেগে তার একদম কাছে গিয়ে চিল্লিয়ে বলি,

–‘তারপর মানে?কারণ বলবেন আপনি৷ আমি কারণ জানতে চাই৷ আমার বাবাকে,ফুপিকে সমস্ত কিছু বলবেন৷আপনি আমার সম্মান নিয়ে খেলছেন কাব্য ভাই৷ বুঝেছেন আপনি!’

কাব্য ভাই এক পাঁ আমার দিকে এগিয়ে আসলেন৷ আর আমি পিছিয়ে যেতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে৷ উনি দুই হাত দেয়ালে রাখেন৷ আমি উনার হাতের ভেতর আটকা পড়ে গেছি৷ এখন প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে আমার৷ হৃদপিণ্ড ধাক ধাক করে লাফাচ্ছে মনে হচ্ছে৷ এখুনি মনে হয় বুকের বা পাশ থেকে বেরিয়ে কাব্য ভাইয়ের উপরে পড়বে৷

–‘দূরে যান!’

–‘কেনো৷’

–‘আমার করা প্রশ্নের উত্তর দিন আপনি৷ হুটহাট একদম কাছে আসা আমার পছন্দ নয়৷’

কাব্য ভাই হু হা করে হেসে উঠলেন৷ আমি উনার হাসি দেখছি৷ সে হাসতে হাসতে একদম শান্ত হয়ে আমার মুখে ফুঁ দেয়৷ তার এমন কাজে আমার শরীরের ভেতর শিহরণ অনুভব হয়৷ কেঁপে উঠি আমি৷ উনি আবার নিজের মুখ এগিয়ে আনে৷ আমি উনার হাতের নিচে দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে উনি হাত নিচু করে ফেলেন৷ আমি উনার দিকে তাকিয়ে বলি,

–‘অসভ্যতামি করছেন কেন আপনি? নিজের সীমার মধ্যে থাকুন৷’

উনি হাত সরিয়ে দিতেই আমি অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাফ ছাড়ি৷ এইবার মিনতির সুরে বললাম,

–‘আপনি কারণ টা বলে দিন আমি সত্যি বলছি চলে যাবো আমি৷ ফুপি বা বাবাকে কাওকে কিছু বলা লাগবে না৷ আমি সামলিয়ে নিবো৷’

উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,

–‘তোকে যেতে দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছি?যেতে দিলে তো বিয়ের দিন যেতেই দিতাম৷’

উনার ধাঁধার মতো কথা শুনে প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার৷ আমি তেতে উঠে বললাম,

–‘তাহলে বিয়ে না করেই রাখবেন?কি হিসেবে রাখবেন৷ বোন হিসেবে তো রাখতে পারবেন না সেই স্কোপ টা আপনি মিথ্যা বলে বন্ধ করে দিয়েছেন৷ রক্ষিতা হিসেবে রাখবেন বুঝি?’

গালে সজোরে উনার শক্ত হাতের থাপ্পর পড়তেই আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যাই৷ মাথা ঝিম ধরে গেছে আমার৷ চারদিক কেমন ঘোলাটে লাগছে৷ আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে৷ উনি আমার সামনে হাটু ভেঙে বসে চিল্লিয়ে বলেন,

–‘তুই যেমন ফালতু তোর কথা বার্তাও তোর মতো ফালতু৷ থাপ্পর টা তোকে আরো আগে দেওয়া উচিৎ ছিলো৷ এতো জানার আগ্রহ কেন তোর?যেভাবে চলছে সেই ভাবে চলতে দিতে বলেছিলাম না?এখন থেকে যত বার এই বিষয় নিয়ে বলবি ততোবার থাপ্পর পড়বে৷’

উনি উঠে দরজা জোরে হাত দিয়ে বাড়ি মেরে চলে যায়। ওইখানে বসেই কান্না করতে থাকি৷ আমার সাথে হয়েছে আর আমিই জিজ্ঞেস করতে পারবো না এইটা কেমন কথা৷ সাইডে থাকা ফুলদানি হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে জোরে জোরে কান্না করতে লাগলাম৷ এমন কেন উনি?মিথ্যা বলে এখন আবার আমায় মারলো? সব কিছু শেষ করে দিবো!আমার সাথে করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারবো কিনা জানি না কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিবো!!!

________________________________________

বেডের এককোণায় বসে এখনো কেঁদে চলেছি আমি৷ ফুঁপি এসে অনেক বার ডেকে গেছে৷ আমি তার কথার কোনো জবাব দেই নি৷ নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগছে৷ আমি কি মূল্যহীন?আমাকে নিয়ে এতো ঝামেলা, সব ছেড়ে চলে যাবো৷ দরজায় আবারো শব্দ হতে চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে ‘কে’ জিজ্ঞেস করতেই ফুঁপি বলল,

–‘নীতু আম্মু,কি হয়েছে৷ খেতে আয়৷’

–‘কিছু না ফুঁপি৷ তুমি যাও খিদে লাগলে খেয়ে নিবো আমি।’

–‘আম্মু,যে খাবে না তাকে এতো জোড় করছো কেন?’

কাব্য ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেতেই না খাওয়ার জেদ আরো চেঁপে বসলো৷

–‘ফুঁপি তুমি ঘুমিয়ে পড়ো৷ আমার চিন্তা তোমাদের কারো করতে হবে না৷ আর আমাকে কারো জোড় করতেও হবে না৷’

ফুঁপি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,

–‘কাব্য কি কিছু বলেছে তোকে?’

কাব্য ভাই আবারও বললেন,

–‘আমার কি ঠেকা পড়েছে? আমার টাইমের দাম আছে আম্মু৷ আর আমি অসভ্য নই যে কাওকে সেধে সেধে কিছু বলবো৷’

উনার বাঁকা কথা শুনে আমার চোখের পানি আবারও চলে আসলো৷ আমি পানি টুকু মুছে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলাম৷ আপনাকে আর আমার মুখ দেখতে হবে না কাব্য ভাইয়া৷ আর না কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে হবে৷ কোথাও যেতে না পারলে নিজেকে শেষ তো করতে পারবো৷ আর হ্যাঁ এইটাই করবো আমি!!!!

শেয়ার করুন