#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৮
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy rahman)
সবার সামনে কাব্য ভাইয়া একহাতে জড়িয়ে রেখেছেন আমায়৷ ড্রয়িং রুমের পরিবেশ ঠান্ডা৷ কারো মুখে কথা নেই কোনো৷ যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্ট৷ ফুঁপি আর রেদুয়ান আঙ্কেল আমাদের তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কাব্য ভাইয়ার চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট৷ সে আমাকে অনেকটা শক্ত করে ধরে রেখেছেন৷ মনে হচ্ছে,সে যদি ছেড়ে দেয় কেও আমাকে নিয়ে যাবে৷”আমির”
আমার সামনে এসে দাঁড়াতে কাব্য ভাইয়া আমাকে আরো মিশিয়ে নেয়৷ আমির তা দেখে মুচকি হাসে৷ আমির নামক মানুষটাকে আমার কোনো কালেই ভালো লাগে নি৷ দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু ভালো লাগে না৷ আর এই ভালো না লাগাটা এখন অস্বস্তি তে পরিণত হয়েছে৷ মনের মাঝে আরেকটা কথা ঘুরছে,আমির যদি জানেন আমার আর কাব্য ভাইয়ের বিয়ে হয় নি তখন সে যদি আমায় নিয়ে যায়?
–‘কেমন আছেন আপনারা?’
পিনপতন নীরবতা ঠেলে আমিরের প্রশ্ন শুনে উত্তর দেওয়ার সাহস যোগাতে পারলাম না আমি৷ কিন্তু কাব্য ভাইয়া বললেন,
–‘আলহামদুলিল্লাহ!তা আপনি এখানে কিসের জন্য এসেছেন? আমাদের সংসার দেখতে বুঝি৷’
আমির মুখে হাসি বজায় রেখে বললেন,
–‘কোথায় গিয়েছিলে নীতু৷’
–‘বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী আর কোথায় যাবে মি.আমির৷ আমরা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে গিয়েছিলাম৷’
কাব্য ভাইয়ার কথা শুনে উনি কিছু একটা ভেবে হা হা করে হেসে বললেন,
–‘ফলস পেপার আর রিপোর্ট অহরহ পাওয়া যায় মি.কাব্য৷’
উনার কথা শুনে কাব্য ভাইয়ার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়েছে৷ এতোক্ষণ মুখে রাগী ভাব থাকলেও সেটা এখন হাসিতে পরিণত হয়েছে৷ উনি আমাকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,
–‘তো?’
–‘আমি নীতুকে আমার বাগদত্তা হিসেবে নিয়ে যেতে পারি সেটা কি আপনি জানেন?’
কাব্য ভাইয়া হা হা করে হেসে বললেন,
–‘আমার বউকে আপনি বাগদত্তা হিসেবে নিবেন৷ হাও ফানি৷’
–‘ওইটা ভুয়া রেজিষ্ট্রি পেপার৷ তাই আপনার কোনো জোর নীতুর উপর নেই৷’
কাব্য ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে পকেটে হাত গুজে আমিরের মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
–‘চেষ্টা করে দেখতে পারেন ওকে নিয়ে যেতে পারেন কিনা৷।আর জোরের কথা বললেন রাইট?আপনার তো চুল পরিমাণেরও জোর নেই ওর উপর৷ আর তার উপর ওর সাথে আমার রেজিষ্ট্রি হয়ে গেছে তাই না আব্বু?’
রেদুয়ান আঙ্কেলের মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি পেপার নিয়ে সোফায় বসে পড়লেন৷ চশমা ঠিক করে পড়ায় মনোযোগ দিতে দিতে বললেন,
–‘এতো কথা বলার দরকার নেই বাইরের কাওকে৷ আর হ্যাঁ! আপনাকে আমার বাড়ির আশেপাশে যেন না দেখি৷’
রেদুয়ান আঙ্কেলের কথা শুনে যতটা অবাক আমি হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক কাব্য ভাইয়া হয়েছেন৷ উনি হা করে তাকিয়ে আছেন৷ নিজেকে সামলিয়ে আবারও তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
–‘আপনি আর একটাও বাজে কথা বললে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো৷ আপনি রীতিমতো হ্যারাসমেন্ট করছেন বাড়ি বয়ে এসে৷ যতসব বড়লোক থার্ডক্লাস মানুষ৷’
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি৷ আমির সবার কথা শুনে কিছু না বলেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
–‘তোমার জন্য সবসময় অপেক্ষায় থাকবো নীতু৷’
আমি উনার কথা শুনে কাব্য ভাইয়ার মুখের দিকে তাকালাম৷ আমিরের কথা শুনে রাগ লাগলো প্রচুর৷ আমি কাটকাট ভাবে জবাব দিলাম,
–‘আপনার অপেক্ষা আপনার কাছেই রাখুন৷ এই আপনার জন্য আমার জীবনটা দোটানায় আছে৷’
আমির আমার কথা শুনে আর কিছু না বলেই চলে যায়৷ এই লোকের ঝামেলা না হলে আজ জীবনের মোড় অন্য হতো আমার। যে যেখানে পারে অধিকার আদায় করতে চলে আসে৷ নিজেকে অধিকারের রাণী লাগছে৷ উফ!বিরক্তিকর৷
_______________________
কাব্য ভাইয়া আবার চুপ হয়ে গেছেন৷ আমাকে দেখলে অন্যদিকে চলে যান৷ খাবারের সময় দেখা হলে বাহানা দিয়ে উঠে চলে যান। আমিও যথাসম্ভব নিজেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ কিন্তু ঘুরেফিরে তার ইগ্নর টা বড্ড লাগছে আমার৷ সব কিছু কেমন অগোছালো লাগছে৷ কাল নতুন ভার্সিটি তে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে রেদুয়ান আঙ্কেল৷ সব আবার নতুন করে শুরু করতে হবে ভেবেই ঘুম পাচ্ছে৷ ভার্সিটিতে উঠার পর তিন চারদিন ক্লাস করেছি তার মধ্যে এতোশত ঝামেলা৷ নিজের ভবিষ্যৎ যেখানে সবাই গোছানোর চেষ্টায় মত্ত সেখানে আমি নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছি৷ সব কিছু মেনে নেওয়া এতোটা সহজ?উহু না! যে পরিস্থিতিতে সবাই থাকে সেই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে হয় নিজের প্রয়োজনের খাতিরে৷ আমিও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছি হয়তো ভালো কিছু হবে এইভেবে৷ বাইরে বাবার কন্ঠের আওয়াজ পেতেই চমকে উঠি । বাবা আমার নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকছে৷ এক মূহুর্তের জন্য সব ভুলে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি বাবা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে কাব্য ভাইয়া আর রেদুয়ান আঙ্কেলের সাথে কুশল বিনিময় করছে৷ আমাকে দেখে বাবা এগিয়ে এলেন৷ তাকে দেখে আমার কান্না গুলো উপচে বেড়িয়ে এলো৷ একছুটে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই৷ বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আদুরে সুরে বলল,
–‘কান্নাকাটি থামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করবি না আমি কেমন আছি?’
–‘তু…মি আমায় বিশ্বাস করো আব্বু৷ আমি সত্যিই কিছু জানি না৷ সব কাব্য ভাইয়ার মিথ্যা নাটক৷’
কান্নার জন্য কথা আটকিয়ে আসছে আমার৷ কাব্য ভাইয়া সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ আমি তাকে পাত্তা না দিয়ে আবার বললাম,
–‘আমাকে ফুঁপি কিছু কিছু বলেছে তাই বলে এমন না করলেও পারতে তোমরা৷’
আব্বু আমাকে উঠিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বললেন,
–‘যা হয় সেটা ভালোর জন্য হয়৷ সব কিছু ভুলে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও তুমি৷’
এমন কথা শুনে বড্ড অভিমান হলো আমার৷ আমি বুঝি ফেলনা? আমি অভিমানের সুরে বললাম,
–‘তুমি মেনে নিয়েছো সব এতো সহজে?তাহলে সেদিন সবার সামনে এমন না করলেই পারতে তোমরা৷’
–‘কাব্য আর তোর বিয়ের রেজিষ্ট্রি যেখানে আগেই হয়ে গেছে আর কি বলার থাকতে পারে৷ আমিরের ভেজালটা ছিলো বলেই এতো সহজে মেনে নিতে হয়েছে৷’
আমি অবাক চোখে কাব্য ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সে মশা তাড়ানোর মতো হাত নাড়ে৷ আব্বু আমার দিক থেকে ঘুরে কাব্য ভাইয়ার সামনে গিয়ে বললেন,
–‘তোর যাওয়ার ডেট কবে?’
–‘আর দু সপ্তাহ পরেই মামু৷’
আব্বু আর রেদুয়ান আঙ্কেল সামনের দিকে এগিয়ে যায়৷ উনি কোথায় যাবেন দু সপ্তাহ পরে? উনি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ আমি উনার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
–‘আমিরের জন্য না হয় বাবা আমাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলো৷ কিন্তু আপনি এতো মিথ্যা কেন বলেছেন?’
–‘তোর বাবা মানে আমার মামুর ঝোলা ভরা শর্ত শুনে তাকে জ্বালানোর জন্য ওই নাটক করেছি৷ ভালো ভাবে তোকে দিয়ে দিলে তোর এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না৷’
আমি উনাকে অনুনয় করে বললাম,
–‘তাহলে কিসের শর্ত?’
–‘তোর থেকে দূরে থাকার শর্ত৷’
আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি৷ উনার বাসায় পাঠিয়ে আবার উনার থেকে দূরে থাকার শর্ত? উনি আমার দিকে এক পা এগিয়ে বললেন,
–‘তোর ছোট মাথায় এতো কিছু ঢুকবে না৷’
আমি গভীর ভাবে সব ভাবছি আর এর মাঝে উনি হুট করে আমার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে আমাকে টেনে তার রুমের বারন্দায় নিয়ে গেলেন৷ আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
–‘নীতু আমাকে দুটো দিন তোর সময় দিবি?যেখানে কোনো প্রশ্ন থাকবে না৷ শুধু তুই আর আমি থাকবো৷ চলে যাওয়ার আগে দুটো দিন চাই তোর কাছে৷ সত্যি বলছি দুটোদিন তোর কাছে সব স্পেশাল হবে৷ তারপর তুই মুক্ত!প্লিজ দিবি আমাকে দুটো দিন?
উনার আবেগমাখা কন্ঠে আমি বিমোহিত হয়ে গেছি৷ এতো সুন্দর করেও উনি বলতে পারেন বুঝি? তাকে কি দেওয়া উচিৎ দুটো দিন?
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৯
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy rahman)
কাব্য ভাইয়া পিছন থেকে শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরে তার থুতনি আমার ঘাড়ে গুজে রেখেছেন৷ তার এহেন কাজে আমার শরীরে ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷ উনার ভারী নিশ্বাস আমার উপর পড়ছে৷ চারদিকে চাঁদের আলোর ছুটোছুটি চলছে৷ পূর্ণ চাদের আলোয় বারান্দায় অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ খেলা করছে৷ সেই অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশের সাথে নতুন এক ভালোলাগার সাথে পরিচিত হচ্ছে আমার মন৷ আজ কাব্য ভাইয়াকে দূরে ঠেলতে ইচ্ছা হচ্ছে না৷ বরং মনে হচ্ছে,উনি এইভাবেই আঁকড়ে রাখুক আমাকে৷ যেখানে তার সাথে আমার প্রত্যেকটা সুন্দর মূহুর্ত থাকবে এই ভরা সুন্দর সন্ধ্যার মতো৷ ঘাড়ে কিছু একটার নরম স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলাম৷ হুট করে মনে হলো,যা হচ্ছে কিছুতেই ভালো হচ্ছে না৷ উনার ঠোঁটের স্পর্শ এইবার গভীর হতেই তার হাতের বাঁধন থেকে ছুটতে চেষ্টা করি৷ আমতা আমতা করে বললাম,
–‘ছাড়ু…ন কাব্য ভা..ইয়া!
–‘উহু,ছাড়বো না৷’
উনি আরো আঁকড়ে ধরলেন আমায়৷ ঘোরলাগা কন্ঠে বললেন,
–‘তুই যদি আমাকে সময় না দিস তবে আমি জোর করে নিবো বুঝেছিস৷’
এই অস্বতি থেকে মুক্ত পেতে তাড়াহুড়ো করে বললাম,
–‘আমি দিবো আপনাকে দুটো দিন৷ প্লিজ ছাড়ুন আমার অস্বস্তি হচ্ছে৷’
উনি নিজের মুখ এগিয়ে আমার গালে চুমু দিয়ে জলদি সরে দাঁড়ান৷ তার এহেন কাজে আমি ফ্রিজড হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ প্রথমে ঘাড়ে আবার গালে? গালে হাত দিয়ে মুছতেই উনি তড়িৎ গতিতে এসে আবার চুমু দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান৷ মুখে মুচকি হাসি টেনে বললেন,
–‘যত বার মুছতে চেষ্টা করবি আমি আবার ডাবল দিবো৷ এতে আমারই লাভ৷ তুই মুছে ফেল৷ এইবার ডাবলের ডাবল পড়বে৷’
আমি দুই হাত গালে দিয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরে বললাম,
–‘আপনি প্রচুর অসভ্য কাব্য ভাই৷ যাকে বলে মাএাতিরিক্ত অসভ্য৷ আপনার এই রুপ অন্য কেও দেখলে নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক করবে৷’
–‘তুই ছাড়া হার্ট অ্যাটাক আর কে করবে৷’
উনার দিকে তাকিয়ে দেখি সে ঠোঁট কামড়ে হাসছে৷ ছিঃ কতো নোংরা হয়ে গেছেন উনি ৷ উনার এমন রুপ দেখলে উনাকে যারা আইডল হিসেবে দেখেন তারা নিশ্চিত দুদিন অঙ্গান থাকবে৷ আমার দিকে এগিয়ে এসে আবার ফিসফিস করে বললেন,
–‘আম্মুর কাছে থেকে কাল সকালে ইমিডিয়েটলি দুদিনের জন্য কোথাও যাবি সেটা বলবি৷ ফারদার মুখ ফসকে একটা উল্টাপাল্টা কিছু বললে তোকে উঠিয়ে দশতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিবো৷ আর ভুলেএ যেন তোর বাপ মানে আমার হিটলার মামু এইসব টের না পায়৷ তাহলে কেলেংকারী হতে একচুলও বাকি থাকবে না৷’
–‘কিন্তু যাবেন কো….
আর কিছু বলার আগেই উনি আবারও গালে চুমু দিয়ে শয়তানী হাসি দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে চলে যান৷ আমি “থ” হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ গালে হাত দিয়ে মুছতে যাবো তখুনি দেখি সে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি আবারও দু গালে হাত দিয়ে ঘুরে বিরবির করে বললাম,’তোর শান্তি নেই নীতু! একদম শান্তি নেই৷ এই কাব্য নামক ভদ্র মানুষের মুখোশ পড়ে থাকা অভদ্র মানুষ তোর জীবন তেজপাতা করে ভাজা ভাজা করে ফেলবে!!
______________________________
ফুঁপির রুমের সামনে পায়চারি করছি আধঘন্টা যাবৎ৷ কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ কাল সারারাত ভাবতে ভাবতে ঘুমাতে পারি নি৷ ফালতু লোক একটা আজাইরা ভেজালে আমায় ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে আরামসে ঘুমাচ্ছেন৷ ইচ্ছা হচ্ছে,ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়ে আসি উনার উপর৷ কি ভাবে কি বলবো সব গুছিয়ে নিয়ে রুমে উঁকি দিয়ে দেখি ফুঁপি জায়নামাজ উঠাচ্ছে৷ বুকের মাঝে ফুঁ দিয়ে নক করলাম৷ ফুঁপি আমার দিকে তাকিয়ে ভেতরে আসতে বলে বলল,
–‘এতো সকালে হঠাৎ ফুঁপিকে মনে পড়লো কেন?’
আমি বেডের উপর বসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললাম,
–‘আঙ্কেল কোথায় ফুঁপি?’
ফুঁপি আমার পাশে বসে বললেন,
–‘তার তো সকালে সেই এককাজ উঠেই রাস্তার মোড়ে চা খেতে চলে যাওয়া৷ ও হ্যাঁ!একটু পর রেডি থাকিস তোকে আজ ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে তোর আঙ্কেল৷ কাল বড় ভাইয়া তোর ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন৷’
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শ্বাস টেনে নিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
–‘ইয়ে মানে ফুঁপি,আসলে ফুঁপি..
–‘তুই তোতলানো শুরু করলি কবে থেকে নীতু? আম্মু তোমার ভাইয়ের এই তোতলা মেয়েকে কেও বিয়ে করবে না৷’
কাব্য ভাইয়া মোবাইল চালাতে চালাতে রুমে ঢুকে উক্ত কথা বললেন৷ আমি তেঁতে উঠে বললাম,
–‘ফুঁপিইইই..তোমার ছেলে সব সময় আমার সাথে মিসবিহেভ করে৷ উনাকে কিছু বলো তা না হলে উনার চুল সব কয়টা ছিড়ে ফেলবো আমি৷’
আমার কথা শুনে আমাকে জোরে একটা ধমক দিয়ে উনি আবার মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিয়ে ফুঁপির কোলে মাথা রেখে আমার কোলের উপর পা দিয়ে শুয়ে পড়েন৷ ফুঁপি উনার চুল জোরে টান দিয়ে শাসনের সুরে বলল,
–‘মেয়েটা যা বলছিলো তা বলতে না দিয়ে এতো ওর পিছে লাগিস কেন তুই৷ ফাজিল ছেলে ওর পিছে আবার লাগলে তোর চুল নীতুর সাথে মিলে আমিও ছিড়বো৷ তোর বাপ আর তুই চান্দি ছিলা হয়ে যাবি৷’
–‘তারমানে তুমি আব্বুর চুল ছিড়ে এতো সুন্দর টাক বানিয়েছো৷ আহা!আমার বেচারা বাপ৷’
উনার কথা শুনে ফুঁপি আবারও উনার চুল জোরে টান দিয়ে হেসে উঠে৷ তাদের মা-ছেলের মাঝে আমাকে কাবাব মে হাড্ডি মনে হচ্ছে৷ আমি তাদের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত কিছু ভুলে গেছি৷ কাব্য ভাইয়া তার পা দিয়ে আমার পেটের উপর আলতো ধাক্কা দিতেই চমকে উঠি৷ উনি আমাকে তাকাতে দেখেই চোখের ইশারায় বলতে বলে আবারও মোবাইল চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ এই যাএায় আমার কেটে বের হওয়ার উপায় না দেখে কান্না পাচ্ছে আমার৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি নিজের পা উঠিয়ে বললেন,
–‘তোর মহা মূল্যবান কথা বলার সময় আমার পা টিপে দিতেই পারিস৷ আর জলদি কি বলবি বল৷ না হলে আজ সারাদিন তোকে দিয়ে পা টেপাবো৷’
উনার এমন কথা শুনে আমি অনুনয়ের চোখে তাকালাম৷ উনি আমাকে পাত্তা না দিয়ে ফুঁপিকে দিয়ে চুল টানাতে ব্যস্ত৷ আমি সাহস নিয়ে বললাম,
–‘ফুঁপি,আমি দুইদিনের জন্য ঐশী দের বাসায় যেতে চাই৷ আমার অনেক নোটস ওর কাছে আছে৷ আর আমি কোথায় আছি ও জানে না৷ অনেক দরকারি নোটস আমার ইমিডিয়েটলি লাগবেই লাগবে৷ প্লিজ তুমি মানা করো না৷ আর আজ ভর্তি হতে যাবো না৷ ওদের বাসা থেকে এসে একবারে ভর্তি হবো৷’
আমি একদমে কথা গুলো বলে হাফ ছাড়লাম৷ কাব্য ভাইয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন৷
–‘কিন্তু….
ফুঁপিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কাব্য ভাইয়া উঠে বসে বললেন,
–‘কোনো কিন্তু নয় আম্মু!ও যদি যেতে চায় যেতে দেও ওকে৷ আর ভর্তির ব্যাপার টা আব্বু চলে গেলে আমি নাহয় সামলিয়ে নিবো৷ সত্যি ওর রিফ্রেশমেন্টের দরকার তাই আর মানা করো না৷ আর হ্যাঁ আমি যাওয়ার আগে ফ্রেন্ডদের সাথে রাতারগুল ঘুরতে যাবো আজ৷ ওদের বারণ করেছিলাম বাট শুনে নি৷ ওরা বললো,জার্মান যাওয়ার আগে আমাদের সাথে কিছুটা টাইম স্পেন্ড করে যা৷ ওদের কথা ফেলতে পারি নি৷ তাই আর মানা করো না৷ লেখিকা,রুবাইদা হৃদি আর আমি যাওয়ার আগে না হয় নীতুকে ঐশীদের বাসায় ড্রপ করে দিয়ে যাবো৷’
উনি তারমানে জার্মান চলে যাবেন? এইকথা মনে হতেই কেমন খারাপ লাগলো একটু৷ এমন কেন উনি?আমাকে একটুও বললেন না৷ ফুঁপি উনার কথা শুনে মুচকি হাসলেন৷বলল,
–‘তুই যখন এগ্রি করেছিস, এইখানে আমার বলার আর কিছুই নেই৷ আর রাতারগুল যাবি এই সময়?এই কয়েকটা দিন বাসায় থাকলে কি হবে তোর৷’
উনি ফুঁপির হাত ধরে বাচ্চাদের মতো বললেন,
–‘প্লিজ আম্মু মন খারাপ করো না৷ আমি কথা দিচ্ছি জাস্ট দুটো দিন লেখিকা রুবাইদা হৃদি ঘুরবো দেন যে কয়টা দিন আছি তোমার পিছু ছাড়বো না৷ প্লিজজজ..
উনার কথা শুনে ফুঁপি রাজি হতেই আবার গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘যেতে চাইলে বিকেলে রেডি হয়ে থাকবি৷ আর একফোটা দেরি হলে তোকে রেখে চলে যাবো৷’
উনি বলেই যেভাবে এসেছিলেন সেইভাবে চলে গেলেন৷ আমি কি বলবো ভাষা খুজে পেলাম না৷ উনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি উনায় জোর করে নিয়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু এখানে কাহিনি তো পুরো উল্টো৷
.
.
বিকেলের হালকা রোদের ঝলকানি সুন্দর লাগছে৷ হালকা হাওয়া শরীরে ছুতেই শিরশির করে উঠছে৷ একটু আগে বৃষ্টি তার নিজস্ব সত্তায় আকাশ ভেদ করে আছড়ে পড়েছে৷ বৃষ্টির পর ঠান্ডা মৃদু হাওয়ার মতো আমার মন উত্তাল লেখিকা,রুবাইদা হৃদি ভাবে বইছে৷ হঠাৎ প্রচন্ড মন খারাপ এসে ভীড় করছে৷ যাওয়ার জন্য রাজী হওয়ার জন্য এখন নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে৷ কেন!কেন? উনার পাগলামি তে রাজী হলাম? হলে তো উনার এই রুপ দেখতে হতো না৷ নিজে থেকে সব করবে আর কষ্টে পুড়াবে আমায়৷ পাশেই উনি একটা মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে ব্যস্ত৷ মেয়েটা কয়েকবার উনার শরীরের উপর এসে পড়ছে৷ কিন্তু উনি কিছু না বলেই মেয়েটার সাথে হাসতে ব্যস্ত৷ আর আমি বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসে উনাদের তামাশা দেখতে ব্যস্ত…
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ১০
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy rahman)
আমার কোমরে হাত দিয়ে একহাতে জড়িয়ে বাসের সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আমায় ধরে রেখেছেন কাব্য ভাইয়া৷ আর অন্যহাতে মোবাইল চালাচ্ছেন৷ ইচ্ছা হচ্ছে,জানালা ভেঙে বের হয়ে যাই৷ উফ!অসহ্য একটা৷ এতোক্ষণ ওই মেয়ের সাথে থেকে বাসে উঠার পর আমাকে মনে পড়েছে তার৷ বাসায় থেকে আসার সময় গাড়ি নিয়ে আসেনি সে৷ তাহলে নাকি ধরা পড়ে যাবে৷ উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে,আমি উনার গোপন প্রেমিকা৷ গোপালগঞ্জ মেইন পয়েন্টে এসে বাসে উঠিছি৷ আর এখান থেকে রাতারগুল যেতে দু ঘন্টার উপর লাগবে৷ এই দুই নামক সংখ্যাটা বড্ড খারাপ৷ গত দুই তারিখে উনার মিথ্যা কথার জালে ফেঁসেছি আবার দুটো দিন আবার দুই ঘন্টা৷ দুই নামক শনি লেগেছে আমার কঁপালে৷ থেকে থেকে উনি তার হাতের বাঁধন শক্ত করছেন আবার কখনো আলগা৷ উনার দিকে তাকিয়ে দেখি এখনো ফোনে পড়ে আছেন৷ কিছুক্ষণ পর পর ভ্রুকুচকে ফেলছে৷ চেহারা দেখে মনে হচ্ছে প্রচুর বিরক্ত উনি কিছু একটা নিয়ে৷ তার ছোট ছোট চুল গুলো কপালে এসে বাড়ি খাচ্ছে৷ উনি বিরক্তি নিয়ে হাত দিয়ে ঠেলে দিচ্ছেন আবার সেই চুল এসে উনাকে বিরক্ত করছে৷ আমি তাকিয়ে আছি উনার মুখে৷ তার চেহারায় মায়া আছে যেটা কাটানো কারো পক্ষে সম্ভব নয়৷
–‘দেখে দেখে আমার উপর নজর লাগা ভালো করে যাতে কোনো পেত্নী আশেপাশে ঘেষতে না পারে৷’
উনার কথা শুনে নজর লুকাতে চেষ্টা করতেই উনি মোবাইল পকেটে রেখে আমাকে আরেকটু জড়িয়ে ধরে বললেন,
–‘নীতু বেবি কি রাগ করছে আমার উপর৷’
উনার টেনে টেনে কথা বলার ধরণ দেখে আমি হেসে উঠলাম৷ উনি আমার অবাধ্য চুল গুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে বললেন,
–‘দ্যাট’স লাইক এ গুড গার্ল৷’
আজ তাকে অন্য কাব্য ভাইয়া লাগছে৷ বদরাগী কাব্য ভাইয়া আর এই কাব্যের মধ্যে বিস্তর তফাৎ৷ আজ একটুও খারাপ লাগছে না তার সাথে৷ বাসস্ট্যান্ডের ওই মেয়েটার কথা মনে হতেই আমার হাসি নিমিষেই মিলিয়ে যায়৷ উনার থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা করি৷ উনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন,
–‘ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে না থেকে কেও একজন প্রশ্ন করতেই পারে৷ আমি আজ তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত৷ সে এই বাসেই সব প্রশ্নের ঝুড়ি শেষ করবে সেটা আগে কথা দিতে হবে৷ বাস থামার পরে সে একটাও প্রশ্ন করলে তাকে সাঁপ ধরিয়ে দিবো সেই ছোটবেলার মতো৷’
আজ তাকে খুব আদুরে লাগছে আমার কাছে৷ ইচ্ছা হচ্ছে তার নামানো গালটা একটু টেনে দিই৷ সেই আশা বাদ দিয়ে আমি অন্য সব প্রশ্ন বাদ দিয়ে ঠোঁট উল্টে বললাম,
–‘ওই মেয়েটা কে?যে বাসস্ট্যান্ডে আপনার সাথে ক্লোজ হয়ে কথা বলছিলো৷’
উনি হেসে উঠে আমার মাথায় আলতো ধাক্কা দিয়ে বললেন,
–‘তুই বোকা আস্ত একটা বোকা’ই থেকে যাবি৷ সেটা আমার আন্টি ছিলো গর্দভ৷ তোর ফুঁপির মামার মেয়ে ছিলো৷ তুই চিনিস না?সিরিয়াসলি!এই এক জ্বালা নানা-দাদা জন্য নিজের সমান মেয়েরা আন্টি লাগে৷ আর তোর মতো হাদারাম তাদের নিয়ে উল্টাপাল্টা মিনিং বের করে৷’
উনার কথা শুনে আন্টির কথা মনে পড়লো আমার৷ ইশ!রুপা আন্টিকে না চিনেই কতো কিছু ভেবেছি৷
–‘আর কিছু?’
–‘হুম অনেক কিছু জানার আছে৷’
–‘তোর কাছে আর বাইশ মিনিট আছে!যা বলার জলদি এই বাইশ মিনিটের মধ্যে বলে শেষ কর৷’ উনি ঘড়ি দেখে টাইম সেট করতেই আমি আওড়ালাম দুইয়ে দুই বাইশ!আবার দুই?
–‘ one minute have gone.’
উনার কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে বললাম,
–‘আমার সাথে আপনার রেজিষ্ট্রি হয় নি তাহলে মিথ্যা কেন বললেন?’
–‘ রেজিষ্ট্রি তোর বিয়ের দুদিন আগেই হয়ে গেছে৷’ উনি বাসের সিটে আবার গাঁ এলিয়ে দিলেন৷ আমি অবাক হয়ে বললাম,’মানে?’
উনি আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে বললেন,
–‘তোর ভার্সিটির রেজিষ্ট্রেশনের জন্য যে সাইন দিয়েছিলি ওইটা বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন ছিলো৷’
আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছি৷ উনি গা দুলিয়ে হেসে উঠলেন৷ উনি চোখ বন্ধ করে বললেন,
–‘ভাব নীতু ভাব!ভাবার জন্য তোর কাছে দুইমিনিট আছে৷তারপর আরো কিছু বলার থাকলে জলদি বলবি৷’
আমি ভাবতে ভাবতে উনার বুকের উপর মাথা রাখি অজান্তেই৷ আর উনি আরেকটা হাত আলতো করে আমার মাথায় রাখে৷
বিয়ের আগের দিন লাস্ট রেজিষ্ট্রেশনের ডেট ছিলো৷ আমি তাড়াহুড়ো করে বের হতেই দেখি কাব্য ভাইয়া বাসার সামনে হাতে হাত গুজে নিজের স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি উনায় দেখে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করে পাশ কেটে সরে যেতে চাইলে উনি গম্ভীর মুখে বলেন,
–‘তোর ভার্সিটি আজ অফ৷ এমাজউদ্দীন স্যার তার বাসার অপজিটে গিয়ে সাইন করে দিয়ে আসতে বলেছ৷’
আমি উনার কথা অনায়াসে বিশ্বাস করে নেই৷ কারণ আমাদের সবার দৃঢ় বিশ্বাস,কাব্য দ্যা গ্রেট ব্রিলিয়ান্ট ট্যালেন্টেট মানুষ যা বলে তাই সত্যি৷ উনি আমাকে তার সাথে করেই নিয়ে যায়৷ যেতেই একজন মানুষ এসে বলে তাকে স্যার পাঠিয়েছে সাইন করে নিয়ে যেতে৷ আর আমিও তাড়াহুড়ো করে না দেখেই সাইন করে দেই৷
আমি আবারও একধাপ অবাক হয়ে যাই৷ নীতু তোর জীবন তুই শেষ করেছিস৷ প্রচুর বোকা নীতু তুই প্রচুর বোকা৷ আমি উনার থেকে মাথা উঠিয়ে কেঁদে দিয়ে বললাম,
–‘এইটা ঘোর অন্যায় কাব্য ভাইয়া!আমাকে আপনি বোকা বানিয়েছেন৷’
উনি চোখ খুলে তাকিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘তোর বাপ মানে আমার মামু কথা শুনলে এমন স্টেপ নিতে কেও চাইতো না৷ আর তোকে আমি বোকা বানিয়েছি দেখে সবাই পারবে নাকি?ইউ আর মাই স্ট্রোং লেডি৷’
–‘একদম ভালো হয় নি কাব্য ভাইয়া৷আপনি অন্যায় করেছেন৷’
–‘একদম চুপ৷’উনি আমায় জোরে এক ধমক দিতেই আশেপাশের মানুষ আমাদের দিকে তাকালেন৷ আর উনি সবার দিকে অগ্নি চোখে তাকাতেই সবাই ঘুরে যায়৷ তার ধমক শুনে কান্নার পরিমাণ বেড়ে যায় আমার৷ উনি মিষ্টি হেসে আমাকে বললেন,
–‘আর একফোটা পানি পড়লে তোর চোখ টেনে তুলে ফেলবো৷ আমি তোকে এইজন্যই বলতে চাইনি৷ আর তোর কাছে আমি অধিকার চেয়েছি?ওইটা জাস্ট একটা নাটক ছিলো প্রমাণ দেওয়ার জন্য৷’
উনার মিষ্টি মুখে চিবানো কথা শুনে কান্না থেমে যায় আমার৷ উনি আবার ঘড়ি দেখে বলেন,
–‘তোর আজকের সময় শেষ নীতু৷ এমন একটা দিন আসবে যেখানে কোনো ধরা বাধা সময় থাকবে না তোর আর আমার মাঝে৷ সেইদিন টার অপেক্ষা কর৷ তোর মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের উত্তর মিলবে একদিন৷ আর অপেক্ষার ফল সব সময় মিষ্টি হয়৷’
উনার কথা শুনে তাকিয়ে আছি আমি৷ উনি আমার কপালে উষ্ণ পরশ দিতেই আমি চমকে উঠি৷ আবার উনি কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলেন….
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ১১
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy rahman)
কাব্য ভাইয়া আমাকে কোলে উঠিয়ে হাঁটু সমান কাঁদা আর পানির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলেছেন৷ উনার মুখে অমায়িক হাসি৷ আমি একহাতে উনার গলা আঁকড়ে ধরে লজ্জায় মরে যাচ্ছি৷ আমার জুতো ছিড়ে গেছে বাস থেকে নামার পর আর পিছন থেকে কিছুতে আটকে আমার জামার পিছনে কিছুটা অংশ ছিড়ে গেছে৷ কাব্য ভাইয়া কিছু না বলেই সবার সামনে কোলে উঠিয়ে হাঁটা ধরে৷ আশেপাশের মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ এখনো সূর্য পশ্চিম আকাশে উঁকি দিয়ে আছে৷ তার হালকা কমলা রাঙা আলোক রশ্মি কাব্য ভাইয়ার মুখের উপর পড়ছে৷ উনার চোখে মুখে উপচে পড়া খুশির ঝলক৷ এখন তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ইনোসেন্ট পার্সোন লাগছে৷ এই কাব্য ভাইয়াকে আমি একদম চিনি না৷ তবে তার মতো অসভ্য দুনিয়ায় আর কেও আছে কিনা সন্দেহ৷ তখন বাসে আমার দিকে ঝুঁকে বলেছিলেন,
–‘তোর আর আমার বাসর কিন্তু হয় নি নীতু! যদি তোর বিয়ে নিয়ে ডাউট থাকে তাহলে এইজায়গার কোনো কাজী অফিসে গিয়ে আবার রেজিস্ট্রি করে ফেলি কি বলিস? তারপর এই রাতারগুল ফরেস্টে আমাদের পানিময় বাসর হবে৷’
ছিঃ!উনি কতোটা নির্লজ্জ ভাবতেই কেমন লাগে৷ আমি বিরবির করে বললাম,
–‘আপনি প্রচুর অসভ্য কাব্য ভাই৷’
উনি আমার দিকে দ্রুকুচকে তাকিয়ে বললেন,
–‘কিছু বললি!’
আমি উনার কথা শুনে দুদিকে মাথা দোলালাম৷ যার অর্থ না৷ বাসা থেকে বের হয়েছিলাম আড়াইটার দিকে৷ এখন বাজে সাড়ে চারটা৷ একটু পর সন্ধ্যা নামবে আর এই সময় উনি ঘুরবেন৷ উনায় বোধহয় প্রথম দেখলাম এই সন্ধ্যা সময় ঘুরবেন রাতারগুলে৷ সিলেটে থাকলেও বাবা কখনো কোথাও ঘুরতে যেতে দেয় নি৷ একমাএ আমি নামক প্রাণী যে কিনা সিলেটে থেকেও কোনো জায়গা চিনি না৷ আর দেশের বাহিরের মানুষ সমস্ত কিছু ঘুরে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলছে৷ এইসব ভেবে নিজেকে ভীনগ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে৷
–‘তোর মতো আলুর বস্তাকে কোলে উঠিয়ে আমার অর্ধেক জীবন শেষ করে ফেলেছি আমি৷ এইখান থেকে ফেরার পর আর বাঁচবো কিনা সন্দেহ৷’
উনার অপমানের সুরে কথা শুনে আমি তীক্ষ্ণ ভাবে বললাম,
–‘আপনাকে কোলে উঠাতে বলেছি আমি?আমাকে নিজে কোলে উঠিয়ে আবার কথা শুনাচ্ছেন৷ এইটা ঘোর অন্যায়৷ আমাকে ছাড়ুন আমি নামবো৷’
–‘এসে পড়ার পর নামতে সবাই চায়৷’
উনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে নিজের ব্লেজার খুলে পড়িয়ে দিলেন যাতে ছেড়া অংশ দেখা না যায়। উনি সামনে এক পাঁ এগিয়ে আবার ঘুরে আমার ব্যাগ উনার হাতে নিয়ে বললেন,
–‘জাস্ট রিডিকুলাউস!এতো বড় মেয়ে সে তার ব্যাগে তালা লাগিয়ে চাবি বাসায় ফেলে রেখে এসেছে৷ তোর বুদ্ধি হাটুর নিচে বললেও ভুল হবে৷’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি নৌকা ভাড়া করতে এগিয়ে গেলেন৷ আমি উনার পিছু পিছু যেতেই কিছু মেয়ে এসে ঘিরে ধরে আমায়৷ এইখানের স্থানীয় হবে হয়তো৷ আমার সামনে এসে আমার বয়সী এক মেয়ে বলে,
–‘আপনার কি হয় উনি৷’
আমি অবাক চোখে কাব্য ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে উনাদের ইশারায় বলি তার কথা বলছে কিনা৷ মেয়েগুলো হই হুল্লোড় করে হ্যাঁ বলতেই আমার মুখে হাসি ফুঁটে উঠে। আমি ভাব নিয়ে বললাম,
–‘আপনারা জেনে কি করবেন?’
একটা মেয়ে মন খারাপ করে বলল,
–‘বলেন না আপু! উনায় দেখে আমরা প্রত্যেকে ক্রাশ খেয়েছি৷ যদিও আমি প্রথম দেখায় একপ্রকার ভালোবেসে ফেলেছি৷’
মেয়েটার কথা শুনে বড্ড মায়া লাগলো আমার তবে মেয়েটার জন্য নয় কাব্য ভাইয়ার জন্য৷ আমি মুখে বিস্তর হাসি টেনে বললাম,
–‘ওও ওইটা! সে আমার বডিগার্ড৷ কিন্তু মাথার তার ছিড়া৷ কি আর বলবো আপু এতো সুন্দর একটা ছেলে কাজ টাজ পায় না দেখে আমার বাবা আমার ব্যাগ উঠানোর জন্য রেখে দিয়েছে৷ জানেন আপু,ছেলেটার না বিয়ে হচ্ছে না৷ বলেন তো কেন?’
–‘কেন?’
আমার কথা শুনে সবাই কাব্য ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে উঠলো৷ উনাদের আগ্রহ দেখে প্রচুর হাসি পেলো আমার৷ হাসলে একদম চলবে না৷ তাই নিজেকে সামলিয়ে দুঃখী দুঃখী ফেস করে বললাম,
–‘একটু পর পর উনার উপর জ্বীন ভর করে৷ আর তখন সামনে যাকে পায় উঠিয়ে আছাড় মারেন৷’
মেয়েগুলো আমার কথা শুনে ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে৷ আমি আরো উৎসাহ নিয়ে বললাম,
–‘তারপর পাগলের মতো আচরণ করে আর কামড়ে দেয়….
–‘তারপর?’
–‘তারপর…..
কাব্য ভাইয়া মেয়েগুলো পিছনে মুখে হাসি টেনে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে৷ উনার কন্ঠ শুনে আমি ভয়ে চুপসে গেলাম৷ আজ তোর শেষ দিন নীতু৷ এই কাব্য নামক মানুষটা তোকে এই রাতারগুলের স্বচ্ছ পানিতে চুবিয়ে মারবে৷ উনি আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই মেয়ে গুলো জোরপূর্বক হেসে চলে যেতে নিলেই কাব্য ভাইয়া বললেন,
–‘তারপর শুনে যাবেন না আপনারা?’
মেয়েগুলোর একজন না বলতেই উনি আমার হাত ধরে বললেন,
–‘এইটা হচ্ছে আমার বউ৷ আর এর মাথায় তীব্র সমস্যা আছে৷ উল্টাপাল্টা বলে আর কি৷ একে পাবনা থেকে নিয়ে এসেছি কয়েকদিন আগে৷ আর তার প্রধান কাজ হলো আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলা৷’
মেয়েগুলো বিস্ফোরিত চোখে আমাদের দুইজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের জাঁলে নিজেই ফেঁসেছি। আমি কাঁচুমাচু করে উনার পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। ইশ! এতোগুলো মেয়ের সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেলো। মেয়ে গুলো যাওয়ার জন্য আবার পাঁ বাড়াতেই উনি জোরে বলেন,
–‘হেই গার্লস,
উনারা আবার পিঁছু ঘুরতেই উনি একগাল হেসে বলেন,
–‘আপনাদের এখানে কোনো ভালো রিসোর্ট আছে থাকার জন্য? এই পাগলটাকে নিয়ে রাতে কোথায় থাকবো বলেন তো। কারণ পাগলের পাগলামী রাতে বাড়ে।’
উনার চোখে মুখে আতংকের ছাঁপ।এইবার বেশী বেশী হচ্ছে। আমি উনার হাত ধরে একটানে নিয়ে আসলাম ওই মেয়েগুলোর সামনে থেকে। উনি উল্টে আমার হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে চোখ মেরে বললেন,
–‘কেসা লাগা বেবি!’
উনার চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির ভাবে বললাম,
–‘একদম বাজে,আপনার মতোই বাজে।’
–‘বাজে…
উনি আমার দিকে মুখ এগিয়ে আনতেই পিছন থেকে কারো ডাকে থমকে সরে মুচকি হেসে বললেন,
–‘শোধে আসলে সব উসুল করবো! ওয়েট কর ঘড়ি ধরে।’
___________________________
সবুজ পানির উপর নীল আকাশ। উহু! নীল নয় হলদে আর কমলা রঙের আকাশ। সারি সারি গাছের মেলা। নৌকার চলার শব্দ।অপরুপ সৌন্দর্য। চোখের ভাষায় বললেও সেই সোয়াম্প ফরেস্টের অপরুপ মহিমা কম পড়বে। চারদিকে বিভিন্ন গাছ পানির উপর মাথা চারা দিয়ে দাড়িয়ে আছে। কোথায় যেন একটা ডাহুক ডেকে চলেছে ক্ষীণ স্বরে।বৈঠার শব্দ আর ডাহুকের শব্দের অন্য এক সুর তুলছে এই নিস্তব্ধ পুরি তে । আমি ঘোর মাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি। সব যেন সবুজের খেলা। চির সবুজ! সবুজ বুঝি এতো সুন্দর হয়?রাতারগুল না আসলে জানতেই পারতাম না। আমার চোখের কোণায় জ্বল এসে জমা হতে শুরু করে। এতো সুন্দর আমি আগে কখনো দেখি নি। হ্ঠাৎ চোখের পাশে কারো হাতের ছোয়া পেতেই টুপ করে সেই পানি তার হাতের উপর পড়ে। কাব্য ভাইয়া সেই পানিটুকু সবুজ এই জ্বলের প্রান্তরে ভাসিয়ে দেয়। আমাকে টেনে তার কাছে নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘এই সৌন্দর্য একা অনুভব করতে হয়!নিস্তব্দ ভাবে। যেখানে কোনো ক্যামেরা আর মানুষের শব্দ থাকবে না।’
আমি উনার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
–‘সব এতো সুন্দর কেন কাব্য ভাইয়া।’
–‘তোর চোখ সুন্দর তাই সব কিছু তোর কাছে সুন্দর লাগে।’
আমি উনার দিকে ঘুরে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললাম,
–‘উহু! প্রকৃতি সুন্দর।’
উনি আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। আজ ছুটোছুটির কোনো তাড়া নেই আমার। ছাউনির ওইপাশে মাঝি নৌকা চালাচ্ছেন। তাই এইপাশের কিছু উনি দেখতে পাবেন না।
–‘এই সন্ধ্যা তোর আর আমার নীতু!’
–‘হু’
–‘হু,কি?’
–‘এই সন্ধ্যা আপনার আর আমার।’
উনি চলন্ত নৌকার মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি আবার বসে বললেন,
–‘এই সন্ধ্যার বুকে তোর আর আমার নাম লিখি ,আমার অক্ষরে?’
আমার মনযোগ তখনো পানি আর গাছের ভেতর আটকে আছে।তার দিকে না তাকিয়ে বললাম,
–‘হুম লিখুন!’
উনি আমার মুখের উপর ফুঁ দিতেই আমার দৃষ্টি উনার দিকে যায়। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
–‘ডিস্টার্ব করছেন কে…….
আর কিছু বলার আগেই উনি আমার ঠোঁট জোড়া তার ঠোঁটে আটকে ফেললেন। আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছি। উনার হাত দিয়ে সরাতে চাইলে উনি আমার চুলের পিছনে হাত গুজে দেন।
অনেকটা সময় পর আমায় ছেড়ে দিয়ে বললেন,
–‘তোর আর আমার প্রথম অক্ষরের সাক্ষী এই রাতারগুল। জানি না আর কবে তোকে কাছে পাবো!তাই এইটা আমার খুব করে প্রয়োজন ছিলো।প্রত্যেকটা দিন আজকের এই সন্ধ্যা সাক্ষী হয়ে থাকবে তোর আর আমার নামে। আমার অনুপস্থিতি তোকে মনে করাবে আজকের সন্ধ্যা।’
আমি উনার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছি। কি থেকে কি হলো সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমি ঠোঁটে হাত দিতেই উনি হাত সরিয়ে বলেন,
–‘আজ যা হচ্ছে হতে দে নীতু।’
আমি উনার হাত সরিয়ে দিয়ে রেগে বললাম,
–‘কেন হতে দিবো?বলুন কেন!’
উনি আমার দুই বাহু ধরে বললেন,
–‘কারণ…