চারদিকে ঘুমন্ত নগরী৷ আর এইদিকে আমি নির্ঘুম৷ আমায় আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছেন কাব্য ভাইয়া৷ আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আরো কাছে এগিয়ে আসেন৷ আর অল্প একটু জায়গা বাকি সোফার৷ আরেকটু এগিয়ে আসলে নির্ঘাত আমার উপরে পড়বেন৷ তার কঁপালে চুমু দেওয়া মহা অন্যায় হয়েছে৷ যদি আমি চুমু না দিতাম তাহলে উনার হাতের বাঁধনে আটকা পড়তাম না৷ উফ! কি জ্বালায় পড়লাম,, সারাদিনের বিভিন্ন কাজে অনেক ক্লান্ত হয়েছে নিশ্চয়৷ এইজন্য কাঁচা ঘুম থেকে উঠানোর ইচ্ছা মোটেও করছে না আমার৷ তার উষ্ণ নিশ্বাস আমার মুখে আছড়ে পড়ছে৷ অন্য অনুভূতি! সে ঘুমে তবুও মনে হচ্ছে, তার নিশ্বাস গুলো দিয়ে আমায় ইচ্ছা করেই জ্বালাচ্ছেন৷ তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো হঠাৎ ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হলো৷ কানের পিঠের সেই তিল টাকেও ছুঁতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ তার গালে হাত বুলাতেই আমার হাতের তালুতে সুরসুরি লাগতেই হাত সরিয়ে নেই আমি৷ আর উনি নড়েচড়ে উঠেন৷ আমি আবার চুপ করে বসে থাকি৷ ঘুমের মাঝেও সে হাসে…! সেই মুচকি হাসি। তার জাম রাঙা ঠোঁট গুলো শুকিয়ে গিয়েছে৷ আমি আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই উনি চুমু দেন৷ আবারো বিদুৎ খেলে গেলো আমার মাঝে আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নেই৷ সপ্ন টপ্ন দেখছেন নাকি উনি? আমি আবার তাকাতেই দেখি মুচকি হাসছেন। আমি এবার নিজের ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি। আদেও কি উনি ঘুমিয়েছেন বোঝার জন্য আবার একটু উনার গালে হাত রাখি। না ..! সত্যি ঘুমিয়েছেন। নীতু,সকাল ছাড়া তোর ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। কি দরকার ছিলো উনার কাছ আসার? তার মুখ আর আমার মুখের মাঝে দু ইঞ্চি পরিমাণের জায়গা খালি আছে কিনা সন্দেহ। থেকে থেকে আমার কঁপালে তার ঠোঁট ছুয়ে যাচ্ছে । এইবার আমার অস্বস্তির পরিমাণ বেড়ে গেলো হু হু করে । কেমন লজ্জা লাগছে সাথে অনুভবের নিদারুণ সূক্ষ্ম ভালোলাগার ছোয়া ।তার ঠোঁট জোড়া আবার আমার কঁপালে ডিপ ভাবে লাগতেই আমি কেঁপে উঠি। উনি আবার মুঁচকি হাসছেন। অসভ্য মানুষ..! তারমানে ঘুমান নি। আমি রাগীভাবে বললাম,

 

–‘ আপনি ঘুমান নি ? ছাড়ুন আমায় …! কি মিথ্যুক ভাবা যায়,ঘুমের ভান ধরে আছে। ‘

 

উনি ছাড়লেন না আরো একটু আঁকড়ে ধরলেন আমায়। আমি উনার বুকের মধ্যে হালকা ধাক্কা দেই যাতে ছেড়ে দেন আমায়। উহু..! সে না ছেড়ে আরো কাছে টেনে নিলেন আমায়। আবার সেই অনুভূতি ! বুকের বা পাশে হৃদপিন্ডের ধুক ধুক আওয়াজ । শুধু আমার না কাব্য ভাইয়ার বুকের বা পাশের যন্ত্রটাও আমার যন্ত্রের মতোই সমান তালে ধুকপুক করছে । উনার অস্বস্তি হচ্ছে আমার মতো? আমার ভাবনার মাঝেই উনি চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলেন,

 

–‘ হার্ট দুটোকে বল, তাদের মালিকদের রোমান্স করতে দিতে । এতো ধুক ধাক শব্দ করলে তাদের মালিকদের রোমান্সে ব্যাঘাত ঘটে তারা জানে না?অশিক্ষিত হার্ট …!’

 

তার এমন কথা শুনে আমি হেসে উঠি। হার্ট ও অশিক্ষিত হয় বুঝি?

–‘ হ্যাঁ হয়! মোর হৃদপিন্ডের রাণী। ‘ উনি আমার মুখের উপর ফুঁ দিয়ে বললেন কথাটা । আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম মূহুর্তেই । কাঁপা ভাবে বললাম,

 

–‘ অশিক্ষিত হোক আর শিক্ষিত … তার মালিক কিন্তু দারুণ অভিনেতা । ‘

আমার কথা শুনে উনি হা হা করে হেসে উঠলেন। আমি চোখ পিটপিট করে খুলে সেই উঁচু দাঁতের হাসি দেখলাম। হাসলে তাকে এতো সুন্দর লাগে কেন? আমার কেমন হিংসে হয়।

 

–‘ আমার সব তো তোর ,তাহলে হিংসে করিস কেন ? হিংসুটে।’

আমি কম্পিত চোখে তার দিকে তাকালাম। মনে কথা উনি শুনলেন কি করে।

–‘ আমার মনের কথা আপনি শুনলেন কি করে ?’

–‘ মনে মনে বলেছিস বুঝি? ‘

–‘ হ্যাঁ ,শুনলেন কি করে? এই আপনি কি ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ,পার্লার আর মনোবিজ্ঞানী হওয়ার চেষ্টা করছেন?’

 

আমার কুচকানো কঁপালের মাঝে আবার কিস করে বললেন,

–‘ বউয়ের জন্য তো আমি সব হতে রাজী ।’

 

তার কথায় আমার চোখে মুখে লজ্জার আবরণ পড়লো। লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। এখন তার কথা গুলো শুনে মনে হচ্ছে,’ তার কথা শোনার জন্যও তাকে আমার চাই ।’

 

একদিনের ব্যবধানে তাকে এতোটা কাছের কেন মনে হচ্ছে? এইটা কি কবুল বলার জন্য? হ্যাঁ, ওই একটা শব্দের জোড় অনেক। যেটা সহজেই একটা মানুষের আত্মার সাথে অন্য একটা মানুষের আত্মার মিল করিয়ে দেয়। হাজার অজানা কারণ এই একটা শব্দের কাছে ফিকে মনে হয়। আমি হাসলাম। জানি না ,তবে আজ তাকে নিজের বলে মনে হচ্ছে ।

 

~” তোর নামের শহরের অজানার ভীরে, ”

রাখবি কি আমায়…..!

ওওও রাখবি কি আমায়?’

~” ছোট শহর জানে ,আমার অজানা মনের কথা,

সেই শহরের ভীড়ে খুজে পেয়েছি তোর নামের কথা…! ”

~” ওওওও রাখবি কি আমায়?

তোর নামের শহরের অজানার ভীরে,,

রাখবি কি আমায়? ”

~” ভালোবাসার ছোট শহরে, তোর ঠোঁটের হাসির

অজানার কারণে ….!

ওওওও রাখবি কি আমায় !”

~ ” তোর ভালোবাসার দ্বীপ্রহরে, থাকবো তোর মনের অজানায়,

ওওও রাখবি কি তোর মনের কোঠায়,,,

থাকবো আমি তোর শহরের ভালোবাসা মোড়া পাতায়…!”

~ ” ওওও রাখবি কি আমায় ?”

( গানটা কিন্তু আমি লিখেছি🙃)

 

আমি থমকে গেলাম..!পুরোটা গান আমার দিকে তাকিয়ে গেয়েছেন উনি খালি গলায় । প্রত্যেকটা কথা যেন আমাকে নিয়ে লেখা । আমার চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তেই উনি চোখের নিচে চুমু দিলেন। পানিটুকু গড়াতে দিলেন না। আমি কেঁপে উঠে তার চোখের দিকে তাকালাম। একরাশ লজ্জা আমায় ঘিরে ধরলো মূহুর্তেই। কি করবো ভেবে পেলাম না। উনার বুকের মাঝেই মুখ লুকাতেই উনি টাল সামলাতে না পেরে আমার উপর পড়ে গেলেন । আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি আমি । ভাগ্যিস আমার উপরে পড়েন নি । তাহলে আজ চ্যাপ্টা হওয়া থেকে কেও বাঁচাতে পারতো না আমায়। উনি হাসছেন । আমি তার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তাকালাম। উনি হাসতে হাসতেই উত্তর দিলেন,

 

–‘ লজ্জা পেলে তোকে রেড ভেলভেট কেক লাগে জানিস ? একদম টুপ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়। ‘

 

আমি আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। উনি আবার বললেন ,

–‘ এখন কিন্তু সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলবো । ‘

 

আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরালাম । শীতল ভাবে বললাম,

–‘ আমার উপরে থেকে উঠুন ।’

–‘ আজ সারারাত এইভাবে থাকবো । ‘

–‘ আমার ঘুম পাচ্ছে…!’

–‘ ঘুমিয়ে পড় !’

–‘ প্লিজ…’

উনি আমার মুখ তার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,

–‘ এক শর্তে উঠতে রাজী !’

আমি থেমে থেমে বললাম,

–‘ কি শর্ত?’

উনি এক গাল হেসে বললেন, ‘ আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে আমার ইজ্জত হরণের চেষ্টা করেছিস …! ‘

 

আমি হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বলালাম,

–‘ একদম না, আপনার কঁপালে মশা ছিলো সেটা সরিয়েছি। ‘

উনি নাক ছিটকে বললেন,

 

–‘ ইয়াক ছি:! নীতু তুমি মশা তাড়ানোর বদলে খেয়েছিস !’

–‘ আপনার মাথা …! আমি তো চু…’

 

নিজের কথার জালে নিজে ফেঁসেছি । উনি হাসলেন আবার । ঘর কাঁপানো হাসি। আমি আবার লজ্জায় পুরো মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেললাম। উনি হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,

–‘ ঘুমের মাঝে যে কাজ করেছিস সেইটা এখন করতে হবে। গুনে গুনে পাঁচটা তাও,,,

 

উনি নিজের ঠোঁট ইশারা করতেই আমি ব্যাথাতুর কন্ঠে বললাম,

–‘ আমার বুকে ব্যথা করছে ! ‘

উনি আতংক নিয়ে তাকালেন। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলেন। ভয় মাখা কন্ঠে বললেন,

 

–‘ গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা? ঔষুধ এনে দিবো । ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস না কেন? এই জন্যই তো ব্যথা করছে । ‘

 

উনার কেয়ারিং কথা শুনে কেমন ভালোলাগার অনুভূতি ছেয়ে গেলো। আমি তাও নিজের ভালোলাগা দূরে সরিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লাম। উনিও আমার সাথে উঠে দাড়াতেই এক দৌড়ে বেডে শুয়ে পড়লাম । উনি তাজ্জব হয়ে দাড়িয়ে আছে! মিথ্যা বুঝতে পেরে হু হা করে হেসে উঠলেন। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে আবার বন্ধ করতেই উনি বললেন,

 

–‘ আজ মিথ্যা বলে পালিয়েছিস..! তবে কাল ? তারপরে? আমার কাছেই আসতে হবে তোর ।’

 

কথা গুলো শুনেও আমি ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। উনি আমার পাশে আসতেই আমি বেডের সাথে একদম লেগে শুয়ে থাকি । উনি আমার উপর কাঁথা টেনে দিয়ে বালিশ নিয়ে সোফায় চলে যেতে নিলেই আমি বললাম,

 

–‘ এতো বড় বেডে এক সাইডে আপনার জায়গা হবে ।’

উনি শুধু হাসলেন। মাঝে কোলবালিশ দিয়ে শুয়ে পড়তেই আমি চোখ খুলে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি । নীতু ইউ ফিল ইন লাভ ? ইয়াপ,,আই ফিল লাভ অন হিম ।’

নিজের মনেই কথা গুলো বিরবির করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

__________________________

 

ড্রাইনিং টেবিলে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে কাব্য ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মোস্তাকিম ভাইয়া রুটি মুখে না দিয়ে হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরে বসে আছেন। আর সিনান আর রাহুল ভাইয়া ফিসফাস করছেন । ইরা মুচকি হাসছে । বাবা আর ফুঁফা বাইরে কোথাও একটা গিয়েছেন আর ফুঁপি রান্নায় ব্যস্ত । আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে বসে আছি। কারণ,কাব্য ভাইয়া আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বড়রা কেও নেই তাহলে কি ভাবতো ভেবেই আমার মাটির নিচে ঢুকে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে। সিনান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললেন,

 

–‘ আহা! আমার বেঁচারা প্রাণপ্রিয় বন্ধু ,সারারাত কাজের জন্য ঘুমাতে পারে নি একদম । তাই খাবার টেবিলে ঘুমাচ্ছে।’

 

সিনার ভাইয়ার কথার মাঝেই মোস্তাকিম ভাইয়া রুটি মুখে পুড়ে বললেন,

–‘ ওও এই ব্যাপার । আমি তো অন্যকিছু ভেবেছিলাম।’

 

উনাদের কথা শুনে কাব্য ভাইয়া কে উঠিয়ে পানিতে চুবাতে ইচ্ছা হচ্ছে আমার । ইরা আমার খোঁচা মেরে বলল,

–‘ হাও রোমান্টিক ইয়ার..! ‘

আমি চোখ বড় বড় করে তাকাতেই ও জুস ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফুঁপি খাবার নিয়ে আসতেই সব চুপ হয়ে যায়। আমি আরেকদফা লজ্জায় পড়ার আগেই ফুঁপি পরিস্থিতি সামলাতে রাগী সুরে বলল,

 

–‘ কাব্য এই কাব্য…! খাবার টেবিলে কিসের ঘুম? সেই ছোট বেলার মতো । টেবিলে ঘুমানোর অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে।’

 

সবাই ফুঁপির কথা শুনে একসাথে ” ও “বলে উঠেতেই কাব্য ভাইয়া ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

–‘নীতু, কাল রাতে আমাকে ধোঁকা দেওয়ার শাস্তি এইটা । ‘

 

ফুঁপি তাকে ডেকেই চলে গিয়েছিলো। ইশ! থাকলে কি অবস্থা হতো ভেবেই উনার মাথা আমার কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললাম,

–‘ আপনার শাস্তি আপনার পকেটে রাখুন । অসভ্য লোক একটা । নিজে ঘুমাচ্ছেন আর কথা শুনতে হচ্ছে আমায়। ‘

 

উনি মাথা নীচু করেই ঘুম কন্ঠে জোরে উত্তর দিলেন,

–‘ এই কেও উল্টা-পাল্টা বকবি না ! নীতু লজ্জা পাচ্ছে ।’

 

উনার বেখেয়ালি কথা শুনে পাশে থাকা গ্লাসের পানি উনার দিকে ছুড়ে মারি আমি । সাথে সাথেই চমকে উঠে তাকায়। আমার দিকে গরম চোখে তাকাতেই সবাই হেঁসে উঠে। সবার মুখে দিকে গরম চোখে তাকাতেই সবাই উঠে চলে যায় । উনি আমার দিকে তাকাতেই আমিও উঠে চলে যেতে নিলেই আমার ওড়না ধরে তার ভেজা মুখ মুছেন। আমি ছাড়াতে চেষ্টা করলেই উনি হাতে পেঁচান। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়তেই উনি আবার আমার কোমর একহাতে পেঁচিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

–‘ এখন এইভাবে বসেই খাবি । পাক্কা দু ঘন্টা আমার সাথে বসে থাকবি। এক পা বাড়াবি তো ….সেটা রুমে নিয়ে বুঝিয়ে দিবো।’

আমি ঢোক গিলে ওইভাবেই বসে রইলাম। ফুঁপি বা কেও এসে এইভাবে দেখলে কি ভাববে ভেবেই কান্না কান্না পাচ্ছে। ঠিক ভাবে খেতেও পারছি না উনি আমার কোমরে সুরসুরি দিচ্ছেন থেকে থেকে । আমি ছাড়তে বললে বলেন,

 

–‘ চুমু খেতে না চাইলে রুটি খা ..!’


#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি

#পার্টঃ২০

#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)

কড়া রোদ এসে পড়েছে ড্রাইনিং টেবিলে! এখনো আমার কোমরে হাত দিয়ে গরুর হাড় চিবুচ্ছেন উনি৷ থেকে থেকে চাপ দিচ্ছেন কোমোরের উপর৷আমি খাবার নিয়ে বসেই আছি৷ উনি টুপ করে আমার গালে চুমু দিলেন৷ আমি তার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই উনি ঠোঁট উচু করে চুমু ইশারা করতেই আমি তরকারির বাটি উঠিয়ে উনার দিকে ছুড়ে দিতে নিলেই সে আমায় ছেড়ে উঠে যায়৷ আমি চিল্লিয়ে কিছু বলার আগেই আবার আমার ওড়না টেনে নিজের মুখ মুছেন৷ আমি টান দিতেই আমাকে টেনে তার সাথে রুমে নিয়ে যান৷ আমি হাত ছাড়িয়ে বললাম,

–‘ এতো এমন কেন আপনি?’

–‘ কেমন? ‘

–‘ জানি না..! বিরক্ত করেন কেন আমাকে? ‘

–‘ আর কিছুক্ষণ সহ্য কর৷ তারপর তোর ছুটি৷ ‘

আমি থমকে দাঁড়ালাম৷ আজ বুধবার৷ মনে হতেই চুপ হয়ে যাই৷ আমতা আমতা করে বললাম,

–‘ কখন যাবেন আপনি? ‘

উনি আমার কাছে..! একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ আমি সরলাম না৷ উনি স্থির ভাবে বললেন,

–‘ বিকেলে..ফ্লাইট রাত একটায়৷ ‘

–‘ ওহহ..! ‘

আমার দিকে আরো আগাচ্ছেন উনি৷ আমি পিছিয়ে গেলাম এইবার৷ পিছাতে পিছাতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলাম৷ উনি তার এক হাত আমার পাশে রেখে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,

–‘ নীতু..!’

তার মুখে নাম শুনে অন্যধরণের ভালোলাগে৷ আমি শুধু চোখ তুলে তাকালাম৷ উনি আমার কোমড়ের পিছন দিয়ে হাত দিয়ে একদম তার সাথে মিশিয়ে নেন৷ আমি চমকে উঠলাম৷ চুপ করে তার হার্টের প্রত্যেকটা শব্দ শুনলাম৷ উনি আমায় জড়িয়ে রেখেই পাশে থেকে হাত বাড়িয়ে পানি নিয়ে গাছে পানি দিতে থাকলেন৷ আমি তার মুখের উপর তাকিয়ে আছি৷ সূর্যের আলোতে তাকে সোনালি লাগছে৷ আমার দিকে না তাকিয়ে উনি বললেন,

–‘ যত ইচ্ছা,মন প্রাণ ভরে দেখে নে৷ ‘

আমি চমকে উঠে তার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম৷ আজ বুধবার আমার মনে ছিলো না৷ সে সত্যিই চলে যাবে..! কষ্ট লাগছে কেন এতো?

বাইরে থেকে ফুঁপার ডাক শুনেই আমায় ছেড়ে উনি বাইরের দিকে চলে গেলেন৷ আমি পিছু পিছু যাই৷ ফুঁপা আর আব্বু দাঁড়িয়ে আছে..! তাকে কিছু কাগজ দিয়ে ফুঁপা বলল,

–‘ সিনান,রাহুল ওরা তোমায় দিতে যাবে৷ আর সব দিকে খেয়াল রেখো৷ নিজের যত্ন নিয়ো৷ ‘

আব্বুও একই কথা বলে চলে গেলেন৷ আমায় দেখে উনি মুচকি হাসলেন৷ বললেন,

–‘ সেবা কর নীতু, স্বামী সেবা..! ‘

–‘ পারি না আমি..! ‘

উনি আমায় আবার টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন,

–‘ আয় শিখিয়ে দেই..!’

আমি উনার কথা শুনে থমকে গেলাম৷ বাইরে বেরুনোর জন্য বাহানা খুজতেই উনি জোর করে আমাকে বসিয়ে দিয়ে,কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন৷ আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম৷ উনি হাত টেনে তার বুকের মাঝে নিয়ে চোখ বুজে শুয়ে রইলেন৷ এতোটা স্নিগ্ধ কেন লাগছে তাকে?

 

বিকেলের হালকা রোদের আলো চারদিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ সবার সামনে কাব্য ভাইয়া আমার কঁপালে উষ্ণ পরশ দিতেই আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকি৷ তার কোনো বাঁধা নেই! সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ সিনান ভাইয়া কিছু বলার আগেই রাহুল ভাইয়া থামিয়ে দেন৷ কাব্য ভাইয়া আমার দুই বাহুতে হাত দিয়ে ধরতেই আমি উনার মুখের দিকে তাকাই৷ তার চোখে-মুখে উদাসীনতা৷ মূহুর্তে আমার বুকের মাঝে একটা কষ্টের সুর তুলে৷ মানুষটা চলে যাবেন..!

–‘ নীতু,

শীতল কন্ঠের ডাক শুনেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি৷ উনি আমায় আবার ডাকতেই চোখ খুলে তাকাই৷

–‘ কথা বলবি না আমার সাথে? ‘

চোখের কোণে পানির আভাস পেতেই আমি লুকাতে চেষ্টা করে বললাম,

–‘ নি..জের যত্ন নিবেন৷ ‘

–‘ আর কিছু? ‘

–‘ ভালো থাকবেন..! ‘

–‘ মিস করবি না আমায়? ‘

আমি এইবার হু-হু কেঁদে দিলাম৷ মিস করবো কিনা সেইটা আবার জিজ্ঞেস করছেন উনি৷ এতো খারাপ কেন? আমি টেনে টেনে বললাম,

–‘ ম..মি..স কর ব বো কেন? আপনার তো যাওয়ার ছিলো৷ আর,, আর..’

উনি আমার মুখের উপর ঝুঁকে বললেন,

–‘ আর? ‘

আমি কাঁদছি! উত্তর দিচ্ছি না একদম৷ উনি আমায় টেনে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন৷ আশেপাশের কেও দেখছে কিনা সেটা মাথায় একদম নেই আমার৷ আমি কান্না করে যাচ্ছি অনবরত৷ সে হাসছে..! মাথা দুলিয়ে হাসছে৷ আমার কান্না দেখে তার হাসি পাচ্ছে৷ আমার পিঠের উপর তার হাত সে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে আমায়৷ ফিসফিস করে বললেন,

–‘ সবাই কিন্তু আমাদের রোমান্টিক দৃশ্য দেখছে৷ ‘

উনার এতোটুকু কথায় তাকে ছেড়ে দূরে যেতে নিলেই হা হা করে হেসে বললেন,

–‘ প্রাইভেসি দিয়ে সবাই চলে গেছে মিসেস. কাল রাতের যে কাজটা করেছিলি সেটা এখন করতেই পারিস৷ এই দেখ আমার চোখ বন্ধ৷ ‘

মূহুর্তেই আমার কান্না থেমে যায়৷ উনার কাছে থেকে ছাড়া পাবার জন্য ছুটোছুটি করছি৷ সেই কাজটা করা ঘোর অন্যায় হয়েছে তোর নীতু..! ঘোর অন্যায়৷

–‘ উম্ম..তাহলে আমি নিজেই নিয়ে নেই কি বলিস?’

আমি আবার মুখে হাত দিয়ে ঢেকে ফেলি৷ আঙুলের সাইড দিয়ে তার হাসি মুখ দেখতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠি৷ উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ তার চোখের দৃষ্টিতে এতো মুগ্ধতা কেন? কেন এতো আকুলতা..! এই চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমের কবিতা অনায়াসে লিখা যায়৷ আমি কি কবিতা লিখবো তার চোখ নিয়ে?

হাতের উপর তার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই আমি হাত নামিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি উনার দিকে৷ এই লোক ভারী অসভ্য…! শেষে কিনা হাতের উপর দিলো৷

–‘ তোর আঙুল ধোঁকা দিয়েছে তোকে! তারা ঠিক ভাবে তোর লজ্জায় রাঙা মুখ ঢাকতে পারে নি৷ আমার কি দোষ বল তো? ‘

উনার হাত আমার কোমোরের উপর এখন৷ আমি তার হাতের উপর হাত রেখে থেমে থেম বললাম,

–‘ ছাড়ুন ত তো। ‘

–‘ ওকে, ছেড়ে দিচ্ছি..! ‘

উনার স্বাভাবিক কথা শুনে একটু অবাক হলাম আমি৷ এতো সহজে মেনে নিলেন কি করে? আমার নামানো চোখের উপর চুমু দিয়েই তিনি ছেড়ে দেন আমায়৷ এইটা কি হলো? চোখের উপর হাত দিতেই উনি চলে যায়।

ইরা আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে৷ হাসতে হাসতে বলল,

 

–‘ হাও রোমান্টিক কাব্য ভাই..! ইশ! তুই গাঁধি, রেসপন্স করবি কি উল্টে উনায় ছাড়তে বলিস৷ আমি হলে,,! ‘

আমি ওর হাত ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে রাগী স্বরে বললাম,

–‘ তুই হলে কি? লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছিলি? ছিঃ! নির্লজ্জ৷ ‘

ইরা ভয় পাওয়ার বদলে আরো হাসে৷ পিছনের দিকে ইশারা করে বলল,

–‘ ফ্রি তে আমরা সবাই সিনেমা দেখেছি..! ‘

ওর হাতের ইশারা দেখে তাকিয়ে দেখি সিনান ভাইয়া আর দাদু দাঁড়িয়ে! আমাকে তাকাতে দেখেই তড়িঘড়ি করে অন্যদিকে ঘুরে যায়৷ কাদের পাল্লায় পড়েছি আমি? ইশ! কি ভাবছে সবাই৷ আজ উনি চলে না গেলে… চলে যাবেন? এই কথাটা মনে হতেই সব ভুলে আবার শূন্য লাগছে৷ ইরা হাসছে,আমি আর কিছু না বলে সামনে তাকিয়ে দেখি সে ফুঁপি কে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি ধীর পায়ে সে দিকে এগিয়ে যাই৷ উনি একহাতে আমাকেও টেনে নেন৷ তার শরীরে কেমন ভরসার ছোঁয়া পাচ্ছি৷ এতো কষ্ট হচ্ছে কেন সে চলে যাবে বলে৷ আবারও চোখের কোণায় পানির আভাস পেতেই উনার গালের ছোঁয়াও পাই৷ সে ইচ্ছা করে তার গাল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দেন৷ আমার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠে৷ এতো কেয়ারিং কেন সে? তার মায়ায় এতো বাঁধছেন কেন আমাকে৷

_______________________

রাতের গভীরতা! সেই সাথে কাব্য ভাইয়ার ঘরের শূন্যতা৷ বুক চিরে কেমন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে থেকে থেকে৷ আমি আমার রুম থেকে তার রুমে এসে পড়েছি৷ তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার লাগানো গাছ গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি৷ আজ সকালেও সে পানি দিয়েছেন গাছে৷ সেই পানির ফোঁটা আমার হাতে লাগতেই আমার চোখের পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে৷ তাকে কি আমি ভালোবেসে ফেলেছি? যাকে দেখলে ভয়ে পালিয়ে বেড়াতাম! আর দুইঘন্টার ব্যবধানে তাকে দেখতে পাবো না ভেবে কান্না পাচ্ছে৷ এই দুই ঘন্টা আমার কাছে দুই বছরের মতো কেন মনে হচ্ছে? আল্লাহ..! কতোদিন তাকে না দেখে থাকবো? তার গলার আওয়াজ শোনার জন্য নিজেকে পাগল পাগল লাগছে৷ সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করেও শান্তি পাচ্ছি না৷ কাব্য,,কাব্য,,এই একটা নাম এই একটা মানুষকে ছাড়া নিজের অস্তিত্ব কেমন বিলীন লাগছে আমার৷ তার ছোঁয়া যেখানে আছে সেখানে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি আজ৷ এতোটা ডেস্পারেট হয়ে পড়লাম কেন আমি? এই জন্যই বুঝি বাবা আর রেদুয়ান ফুঁপা শর্ত দিয়েছিলেন তাকে? উফফ! তাকে কেন দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে! সামনে থাকলে দূরে ঠেলে এখন কেন এতো শূন্য লাগছে৷ আচ্ছা,উনার কি আমার কথা মনে পড়ছে না? সোফার সামনে ধপ করে বসে পড়ি৷ কান্না পাচ্ছে..! দরজা ধাক্কানোর শব্দে চুঁপ করে বসে থাকি আমি৷ জিনিয়া ডাকছে৷ জবাব দেওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে না৷ ফুঁপি এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলল,

–‘ নীতু, আম্মু..! আমি জানি তুই কাব্যের রুমে৷ দেখ জিনিয়া তোর জন্য কাঁদছে! তোর ফুঁপা আর বাবা না খেয়ে বসে আছে তোর জন্য৷ আমাদের কি ভালো লাগছে বল, কাব্যকে ছাড়া? মেনে নিতে হবে যে! ‘

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,

–‘ ফুঁপি, তোমরা খেয়ে নাও৷ আমি পড়তে বসেছি! ক্লাস টেস্টের অনেক পড়া বাকি৷ ‘

ফুঁপি আর কিছু বলল না৷ হয়তো তার মন আমার চেয়ে খারাপ বেশী৷ আবার দরজা ধাক্কানোর শব্দে নড়েচড়ে বসি আমি৷ জিনিয়া আর ইরা চিল্লিয়ে বলছে,

–‘ ভাইয়া ফোন করেছে। নীতু নামক কাওকে চাচ্ছে৷ কিন্তু সে তো নেই৷ ভাইয়া ফোন কেটে দাও..’

উনি ফোন করেছে শুনেই ওড়না হাতে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে একটানে মোবাইল কেঁড়ে নিয়ে ধপ করে ওদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেই৷ ব্যাপার টা এতো জলদি হয়েছে ওরা অবাক চোখে তাকিয়ে হো হো করে হেসে দেয়৷ হাসুক..! ফোন নিয়ে বুকের সাথে চেঁপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি দরজায় ঠেস দিয়ে৷ দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই৷ ফোন কানে নিতেই গাড়ির শব্দ সাথে সিনান,রাহুল আর মোস্তাকিম ভাইয়ার হাসির শব্দ৷ ফোন কাঁনে নিয়ে উনার নিশ্বাসের শব্দ শুনছি৷

–‘ তোর হার্টের শব্দ তো গানের চেয়ে মারাত্মক নেশা লাগানো৷ ‘

উনার কথা শুনে লজ্জায় পড়ে যাই৷ কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,

–‘ এয়ারপোর্টে পৌছে গেছেন? ‘

–‘ না..! রাস্তায় এখনো৷ ‘

–‘ ওহ..!’

আবার নীরবতা৷ নিশ্বাসের ফিসফিস৷ তার গলার আওয়াজ শোনার জন্য এতো আকুল হয়ে ছিলাম এখন কোনো কথা খুজে পাচ্ছি না৷ আমার চুপ থাকা দেখে সে নিজেই বলল,

–‘ কাঁদছিস কেন? ইউ মিস মি? ‘

আমি চমকে উঠলাম৷ উত্তর খুজে পেলাম না৷ উনি আবার বলল,

–‘ দুইঘন্টায় বউ আমার কেঁদে কেটে নদী বানাচ্ছে৷ বাংলাদেশ থেকে এখনো যাই নি এতেই এই অবস্থা..! না জানি বছরের পর বছর থাকলে এসে দেখবো সিলেট তার চোখের পানিতে ডুবেই গেছে৷ ‘

রাহুল ভাইয়া ভয়ার্ত ভাবে ফোঁড়ন কেটে বলল,

–‘ নীতু,বেহেনা! তোর কাব্য ভাইয়ের জন্য কেঁদে সমুদ্র বানিয়ে আমাদের ভাসিয়ে দিস না প্লিজ৷ আমরা সিঙ্গেল ভাই ব্রাদার বিয়ে না করেই ডুবে মরতে হবে যে৷ ‘

আমি হেসে ফেললাম৷ হাসির শব্দ শুনে কাব্য ভাইয়া বললেন,

–‘ হাসিস না..! আমার কষ্ট হয় যে৷ ‘

–‘ পৌছে ফোন দিয়েন৷ ‘

উনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন৷ সিরিয়াস ভাবে বললেন,

–‘ আই মিস ইউ লট..! রাতের খাবার খেয়ে নে জলদি৷ আর ফোন এইটা তোর৷ প্লেনে উঠার পর আর কানেক্টেড থাকতে পারবো না তাই ফোন রাখিস না৷ ‘

আমিও ফোন কানে রাখলাম৷ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশ দেখে চলেছি আর উনি ফোনে৷ কথা বলছেন না৷ আমিও বলছি না৷ এখন একটু শান্তি লাগছে৷ চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে যাবেন উনি৷ আমি ধীর কন্ঠে নীরবতা ভেঙে বললাম,

–‘ আই মিস ইউ..! ‘

–‘ কি বললি শুনতে পেলাম না! ‘

রাগ হলো আমার৷ সিরিয়াস মোমেন্টে হেয়ালি না করলে হয় না উনার৷

–‘ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ‘

–‘ জানি না। তবে ভালো লাগছে না৷ সব কিছুতে আপনাকে খুজে বেড়াচ্ছি কেন বলতে পারবেন? ‘

অজান্তেই কথা গুলো বলে চুপ হয়ে গেলাম৷ তবে বলতে পেরে ভালো লাগছে সাথে লজ্জা৷ লজ্জা পেয়েও আজ হাসলাম৷ কারণ লজ্জায় পড়লে সে দেখতে পাবে না সাথে আবার লজ্জায় ফেলতেও পারবে না৷

উনি ফিসফিস করে বললেন,

–‘ এই তোর নিশ্বাস কিছু একটা বলছে..!’

আমি ভ্রুকুচকে বললাম,

–‘ কি বলছে? ‘

–‘ ফিরে আসেন..! ফিরে আসেন..! মন যে নিয়ে গেছেন লাগেজে করে..! ‘

হাসলাম আমি৷ লোকটা পারেও বটে৷ সত্যি কি আমার মন নিয়ে গেছেন উনি? আমি বিরবির করে বললাম, ‘ সত্যি যদি ফিরে আসতেন..! ‘

জানি না সে আমার কথা শুনেছে কি না তবে উনি সুর টেনে বললেন,

— ‘ আসবো ফিরে এই আমি,

তোমার মনের দরজার কোণে,,

দোর খুলে দেখো,,

দাঁড়িয়ে আছি হাত বাড়িয়ে..! ‘

কাব্য ভাইয়ার বলার মাঝেই সবাই ‘ বা বা! ‘ করে উঠলেন৷ আমি ফোন রেখে দেই৷ লজ্জা লাগছে অনেক৷

উনি আবার ফোন দিলেন৷ আমি ধরলাম না৷ তিন চারবার বাজতে বাজতে কেটে যেতেই আমার বুকের মাঝে হু হু করে উঠে৷ আর কিছুক্ষণ তার পরেই চলে যাবেন বহু দূর৷ আর চাইলেও তাকে ছুঁতে,, চোখের সামনে দেখতে পাবো না৷ কতোদিন? কত ঘন্টা? আমি যে তিন ঘন্টার দূরত্ব মেনে নিতে পারছি না৷ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷ এতো কষ্ট কেন লাগছে৷

জোনাকিপোকার আলোয় চারদিক চিকচিক করছে৷ সেই রাতারগুলের রাতের মতো৷ আজ তো সে পাশে নেই..! কেন?কেন?

এই অন্দকার বারান্দায় আজ বসে থাকতে একদম ভয় লাগছে না৷ মনের কোণে শূন্যতা থাকলে ভয় বুঝি লাগে? একদম না..!

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর ফোনের ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠি আমি৷ কাব্য ভাই কলিং… এইবার আর দেরি করলাম না একদম৷ ফোনটা ধরতেই ওপাশে নিস্তব্ধতা৷ কাঁপা কন্ঠে বললাম,

–‘ প্লেনে বসে গেছেন বুঝি? আমি যে বিদায় দিতে পারবো না৷ ‘

–‘ নীচে নেমে আয়৷ ‘

সিনান ভাইয়ার কন্ঠ..! নীচে নামবো কেন? বুকের মাঝে ধক করে উঠলো৷

–‘ কাব্য ভাইয়ার ফোন আপনার কাছে কেন?’

–‘ নীচে আয় নীতু,,

–‘ এই সিনান ভাইয়া, নীচে নামবো কেন? কি বলছেন উল্টো পাল্টা৷ ‘

ওইপাশ থেকে জবাব এলো না৷ লাইন কেটে গেছে৷ আমি ওড়না খুজে এক দৌড়ে গেটের সামনে যাই৷ বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যাথা করছে৷ হঠাৎ নীচে আসতে কেন বললো৷ আর কাব্য ভাইয়া? তার ফোন সিনান ভাইয়ের কাছে কেন৷ অজানা ভয়ে দরজা খুলে বাগানে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি,,,


#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি

#পার্টঃ২১

#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy rahman)

বাগানে রাঁতের আঁধার! বাগানের লাইট গুলো থেকে মৃদু আলো এসে পড়ছে৷ সবাই মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৷ কাব্য ভাইয়া ক্লান্ত মুখে লাগেজের উপর বসে আছেন৷ আমার কান্নার মূল কারণ হচ্ছে তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা,,সাথে হাতেও! উনি আমার কান্না দেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে আমায় হালকা হাতে জড়িয়ে ধরলেন৷ আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম৷ সিনান, রাহুল আর মোস্তাকিম ভাইয়া ঠিক আছেন ৷ তাহলে উনি ব্যথা পেয়েছেন কি করে? ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে শুকিয়ে গেছে৷ ফুঁপি উপর থেকে দৌড়ে আসলেন সাথে বাকিরা৷ সবার চোখ-মুখ শুকনো লাগছে৷ ফুঁপি এসেই কেঁদে উঠলেন৷ কাব্য ভাইয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন৷ ফুঁপ্পা তার হাত ধরে বললেন,

–‘ এইসব কি করে হলো,গাছের সাথে গাড়ির ধাক্কা লাগলো কি করে কাব্য? ড্রাইভ কে করছিলো? ‘

সবাই কাঁচুমাচু করছেন৷ ফুঁপি নিজেকে স্বাভাবিক করে কাব্য ভাইয়ার হাত ধরে বলল,

–‘ ছেলেটা ব্যাথা পেয়েছে! এখন এইসব কথা না বললে হয় না তোমার? ‘

ফুঁপা কাব্য ভাইয়ার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে রইলেন৷ সেই চোখের ভাষা আমরা না বুঝতে পারলেও বাকি চারজন ঠিক বুঝতে পেরেছে৷

–‘ হিমানী তোমার ছেলেকে বাসায় ডুকতে বলো৷ আজ সে যেটা করেছে এর বিহিত করতেই হবে৷ বাসার বাইরে আমি কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাই না৷ ‘

ফুঁপা কথাটা বলেই দ্রুত বাসায় ঢুকে গেলেন৷ সবাই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে৷ ফুঁপি আর আমি প্রশ্নসূচক চোখে তাকাতেই কাব্য ভাইয়া ব্যাথাতুর কন্ঠে বললেন,

–‘ আ’ম টায়ার্ড..! তার উপর মাথা ব্যাথা করছে আম্মু! আমি কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না এখন৷ ‘

ফুঁপি আর কোনো প্রশ্ন না করেই সিনান ভাই সহ সবাইকে বাসায় ঢুকতে বলল৷ আমায় বলল, কাব্য ভাইয়াকে রুমে নিয়ে যেতে৷ ফুঁপি চোখ মুছে পা বাড়ানোর আগে কাব্য ভাইয়া পিছনে থেকে ডেকে ধীর কন্ঠে বললেন,

–‘ আম্মু, ড্রাইভ আমি করছিলাম৷ ‘

ফুঁপি ঘুরে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বললেন,

–‘ তাহলে এক্সিডেন্ট হলো কি করে? সিনান বা রাহুল ওদের ড্রাইভিং ভালো না৷ কিন্তু তোমার? তুমি তো সুন্দর ভাবেই ড্রাইভ করো৷ ‘

তিনি আর কিছু বললেন না৷ রাহুল ভাইয়া রেগে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

–‘ ইচ্ছা করে গাছের সাথে ধাক্কা লাগিয়েছে৷ মোস্তাকিমকে ড্রাইভিং সিটে থেকে উঠিয়ে নিজে ড্রাইভ করছিলো৷ তুমিই বলো আন্টি, এই কাজ করার কোনো দরকার ছিলো? বাই এনি চান্স ব্লাস্ট হলে আমাদের কি হতো? ‘

–‘ আম্মু, ‘

রাহুল ভাইয়ার কথার মাঝেই কাব্য ভাইয়া ডেকে উঠলেন ফুঁপিকে৷ ফুঁপি তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল,

–‘ এমনটা করার কারণ? ‘

–‘ আমি বুঝে উঠতে পারি নি৷ ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছিলাম৷ আমি জানি না, বাট যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিলো না৷ ‘

আমি তাদের কথার মানে বুঝতে পারছি না একদম৷ সাহস জুগিয়ে বললাম,

–‘ আপনার ফ্লাইট, আপনার সপ্ন সব নষ্ট করার মানে কি কাব্য ভাইয়া? কিসের জন্য ডেস্পারেট আপনি? ‘

–‘ তোর জন্য! ‘

আমি শিউরে উঠলাম তার কথা শুনে৷

–‘ যাওয়ার আগেই বারণ করতে পারতি কাব্য..! তোর জন্য আমাদের জীবন ঝুঁকিতে ছিলো৷ তুই পাগল হয়ে গেছিস৷ পুরো উন্মাদ৷ ‘

কাব্য ভাইয়া সিনান ভাইয়ার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন৷ বললেন,

–‘ ব্যাথা পেয়েছিস? ‘

হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলেন সিনান ভাইয়া৷ মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘ না! ‘

কাব্য ভাইয়া ফুঁপির দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,

–‘ তুমি আব্বুকে বুঝাও..! আমি উনাদের ইমেইল পাঠিয়ে দিয়েছি৷ তারা ফিডব্যাক দিয়েছে,,টাইম দিয়েছে আমায় সুস্থ হওয়ার৷ ‘

ফুঁপিও আর কথা বললেন না৷ রেগে বাসায় ঢুকে গেলেন৷ আমি উনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি৷ মোস্তাকিম ভাইয়া আমাদের সামনে এসে বলল,

–‘ শালা..! তোর জন্য আজ জীবন অর্ধেক নাই হয়ে যাচ্ছিলো৷ হুট করে এমন একটা প্ল্যান কি করে করলি তুই? ‘

–‘ রিজন ছাড়া ফ্লাইট ক্যান্সেল করতে পারতাম না!’

সিনান ভাইয়া তার হাতের ব্যান্ডেজের উপর থাপ্পড় মেরে বললেন,

–‘ তুই পাগল,,বদ্ধ উন্মাদ.. হুট করে এতোটা উন্মাদনা কে নিজের ভেতর পুষলি কি করে? আজ একটু হেরফের হলে মরতেও পারতি তুই৷ ‘

কাব্য ভাইয়া মাথা দুলিয়ে হাসলেন৷ আমার দিকে স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন,

–‘ হঠাৎ করে উন্মাদ হয়ে গেছি৷ দুনিয়া ক্ষনিকের৷ এই ক্ষনিকের যতটুকু সময় আমার কাছে আছে সেটা আমি আমার আমিকে নিয়ে পার করতে চাই৷ যেন মরলেও আফসোস না থাকে৷ লাইফ,ক্যারিয়ার সব হবে, কিন্তু ফেলে যাওয়া সময়.. সেটা কখনো ফিরে পাবো না৷ আমি আমার জন্য ধার্য্য করা সময়টুকু শান্তি মতো বাঁচতে চাই৷ আর সেই চাওয়াটুকুর মাঝে এমন একজন হুট করেই আমার সাথে জড়িয়ে গিয়েছে৷ সেই মানুষটাকে নিয়েই আমার ছোট দুনিয়া সাজাতে চাই৷ এই সাজানোর সময়টুকু তে তাকে যদি পাশে না পাই তাহলে মরে গেলেও যে আফসোস থেকে যাবে৷ ‘

সবাই উনার বলা কথায় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে৷ আর উনি আমার দিকে৷ সেই মানুষটা আমি! ভাবতেই ভালোলাগার একরাশ ছোঁয়া দোল খেয়ে গেলো মনের মাঝে৷ আজ চলে যাওয়াটা যে ভাবেই হোক আটকে গিয়েছে সেটা নিয়ে আফসোস করবো না ফিরে আসাটা নিয়ে খুশি হবো বুঝতেই সে আমার হাত ধরলো৷ চমকে উঠে তার দিকে তাকাতেই সে ম্লান হেসে বললেন,

–‘ আমি জানি না কোনটা ঠিক বা ভুল,,আমি তোর মোহে পড়েছি৷ সেটা আমি কাটাতে চাই না৷ আমি তোকে পাশে চাই সব সময়৷ দূরে থেকে পাশে থাকা গেলেও আমি কাছে থেকে পাশে থাকতে চাই৷ এতে আমার ক্যারিয়ার কি হবে সেটা ইস্যু করে না আমার কাছে৷ ‘

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না৷ এতোটা কম সময়ে এতোটা গভীর ভাবে উপলব্ধি বুঝি প্রেমিক পুরুষ দের হয়? আচ্ছা উনি কি সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষ, ‘ যার বাইরের কাঠফাটা রৌদ্দুর, ভেতরে প্রেমের বৃষ্টি! ‘

যে বৃষ্টি শুধুই তার প্রেয়সীর জন্য…! প্রমের বৃষ্টি৷

_________________________

আমি উনার একদম মুখের সামনে বসে আছি৷ আর সে আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে৷ তার ঠোঁটের কোণে কেটে যাওয়া জায়গাটা আমি পরিষ্কার করছি৷ উনি ব্যথা পাবেন বলে ধীরে ধীরে কটন দিয়ে আলতো চাপ দিচ্ছি৷ উনার চেয়ে ব্যাথা বোধহয় আমার লাগছে৷ আমি নিজে থেকে তার এতোটা কাছে আসি নি কখনো৷ আমি তো তার ব্যাথা কমানোর জন্য এসেছি এতোটা কাছে তাও নিজের অজান্তে৷ আমার মাথায় শুধু ঘুরছে তার ব্যাথা কিভাবে কমাবো৷ তার নিশ্বাসের হাতছানি গুলো আজও বিরক্ত করছে আমায়৷অবাধ্য ছোট চুল গুলো তার নিশ্বাসের তালে তালে উনার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে৷ আমার সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই৷ উনি আজও ইচ্ছা করেই ফুঁ দিচ্ছেন৷

–‘ গোঁলাপি মিষ্টি,, খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়! ‘

আমি উনার কথার মানে বুঝতে না পেরে বললাম,

–‘ গোঁলাপি মিষ্টি তো বাসায় নেই! কাল সকালে ফুঁপিকে এনে দিতে বলবো৷ ‘

–‘ তোর ফুঁপি কোথায় পাবে? ‘

আমি মেডিসিন লাগাতে লাগাতে বললাম,

–‘ কেন! ফুঁপাকে বলবে আর ফুঁপা বাজার থেকে এনে দিবে৷ ‘

উনি রহস্যজনক ভাবে হাসছেন৷ আমি সেদিকে পাত্তা দিলাম না৷ আগে মেডিসিন লাগিয়ে ফুঁপির আদেশ মতো উনায় খাবার দেওয়ার পরেই আমার শান্তি৷ লোকটার হেয়ালির জন্য আজ কতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেত..! ভাবলেই আমি শিউরে উঠছি৷

— ‘ তোর ফুঁপা বাজারে সেই মিষ্টি পাবে না৷ ‘

আমি শেষ করে উঠতে নিলেই উনি আমার কোমরের পিছনে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন৷ তার এহেন কাজে ভেবাচেকা খেয়ে যাই আমি৷ আমি থেমে গেলাম৷ কারণ নড়াচড়া করলে উনার অন্যহাতে ব্যাথা পাবেন৷ ভণিতা না করে বললাম,

–‘ ছাড়ুন তো..! আপনার খাবার আনতে যাবো৷ আর ওই মিষ্টি ইমপোর্টেড নাকি? যে বাজারে পাবে না৷ ‘

উনি হাসলেন৷ আমি ভ্রু কুটি করে তার দিকে তাকিয়ে আছি উত্তরের আশায়৷ উনি নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে ঘষলেন৷

–‘ বড় হবি কবে পিচ্চি? ‘

পাগল টাগল হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই৷ তাই উল্টাপাল্টা বকছেন৷ শেষে কিনা পাগল? এইছিলো আমার কঁপালে৷ আমার কঁপালে চিন্তার ভাজ দেখে উনি আমায় টান দিলেন৷ টাল সামলাতে না পেরে তার উপর পড়তেই ব্যাথায় শব্দ করে উঠে উনি৷ আমি ভড়কে যাই৷ তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলে ব্যাথা নিয়েই সে আঁকড়ে রাখে৷ আমি চিন্তিত স্বরে বললাম,

–‘ ইশ! কোথায় ব্যাথা পেয়েছেন? আপনার বুদ্ধি দিনে দিনে নাই হয়ে যাচ্ছে কাব্য ভাই..! টান দিলেন কেন এইভাবে৷ ব্যাথা তো আপনি’ই পেলেন৷ ‘

–‘ ব্যাথা আমার চেয়ে বেশি তুই পেয়েছিস তা কি জানিস? ‘ স্নিগ্ধ কন্ঠে বললেন উনি৷

আমি উঠে যেতে নিলেই আবার বললেন,

–‘ আমার গোঁলাপি মিষ্টি খেতে বড্ড ইচ্ছা হচ্ছে৷ ‘

–‘ আরে ভাই..! উঠতে তো দিন আগে৷ ধরে রেখেছেন এইভাবে৷ না উঠলে আনবো কি করে? ‘

আমার কথায় উনি হো হো করে হেসে উঠলেন৷ হাসি থামিয়ে আমার চুল গুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে সিরিয়াস ভাবে বললেন,

–‘ তোর আনতে হবে না..! আমি’ই নিয়ে নিচ্ছি৷ ‘

–‘ দয়া করে আনুন আর আমাকে ছাড়ুন৷ ‘ আমি উনার থেকে ছাড়া পাবার জন্য বললাম৷ উনি নিজের ভ্রু কুচকে বললেন,

–‘ সত্যি নিবো? ‘

–‘ হ্যাঁ,,নিন! ‘ আমি বলতেই উনি তার ভালো হাত দিয়ে আমার মাথার পিছে হাত দিতেই চমকে উঠি আমি৷ তার গোঁলাপি মিষ্টি..! আমার ঠোঁট গোঁলাপি৷ মনে পড়ার আগেই সে আঁকড়ে ধরে৷ হার্ট বিট ক্রমেই বেড়ে চলেছে সাথে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷ ধুকপুকের মাএা বেড়েই চলেছে সেই সাথে তার ছোঁয়া৷

উনি ছেড়ে দিতেই আমি কান্না করে দিলাম৷ এতো খারাপ কেন উনি? আমার কান্না দেখে নিজে উঠে বসলেন৷

–‘ এই নীতু,’

–‘ আপনি পঁচা..! বড্ড খারাপ..! ‘ কাঁদতে কাঁদতেই বললাম৷ উনার চোখে মুখে অপরাধীর ছাঁপ৷ চুপ করে বসে আছেন৷ আমি আড়চোখে তাকালাম তার দিকে৷ ঠোঁটের কোণা দিয়ে আবার রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷ কান্না ভুলে আমি উঠে দাঁড়াতেই উনি আমার হাত ধরেন৷ আমি পিছু ঘুরতেই উনি বললেন,

–‘ নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলি কেন তোর মাঝে? আমি যে বড্ড আসক্ত হয়ে যাচ্ছি৷ আই প্রমিস তোর অনুমতি বিহীন আর কাজ করবো না৷ ‘

আমি উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম৷ উনি তাকিয়ে রইলেন৷ আমি আবার ফাস্টএইড বক্স হাতে উনার সামনে দাঁড়ালাম৷ উনি চোখ তুলে তাকালেন না৷ আমি উনার থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঁচু করতেই আমার বুকের মাঝে ধক করে উঠে৷ চোখ গুলোতে কেমন অনুতাপের ছাঁপ৷ আমি এইবার নিজের কাছে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম৷’ সে আমার! আমি তার..! ‘ তার অধিকার আছে আনার উপর৷ আমি মুচকি হাসলাম৷ আমার হাসি দেখে মনে হচ্ছে উনি প্রাণ ফিরে পেলেন৷ আবার আমার সাথে দুষ্টমি করা শুরু করলেন৷ আমার বিরক্ত কাজ করছে না একদম৷ ভালো লাগছে৷ তাকে আগলে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ তাকে ছাড়া নিজেকে শূন্য মনে হয়৷ এতোটা কাছের আগে তো মনে হয় নি৷’ কিছু কিছু জিনিসে শূন্যতা অনুভব করা ভালো কারণ শূন্যতার ভালোবাসায় আবেদন থাকে, একে অপরকে হারানোর ভয় থাকে, একসাথে পথ চলার অনুপ্রেরণা থাকে৷ ‘

 

~” রাতের আঁধার ঘুচে যাবে, তোমার কাছে এসে! ‘

এই আমি’তে তোমায় খুজে বেড়াবো

ভালোবাসার ঘরে..!

~ ” যে আমিতে থাকবে তুমি, আমায় জড়িয়ে! ‘

রাতের আঁধার ঘুচে যাবে,তোমার কাছে এসে..! ‘

______________________________

সকালের আলো তার সাথে ঘড়ির কাঁটা নিজস্ব গতিতে ঘুরে চলেছে৷ সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অস্বস্তির পরিমাণ৷ ফুঁপা সোফায় বসে কাব্য ভাইয়ার দিকেই তাকাতেই সে ফুঁপার পাশে বসে পড়ে৷ মোস্তাকিম ভাইয়ার সবাই উপরে৷ আমি, ফুঁপি আর ফুঁপা ছাড়া এখানে কেও নেই৷ ফুঁপা তার দিকে কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

–‘ কাল যা করেছিস.. তাতে তোকে থাপ্পড় মারলেও কম হবে৷ দিনে দিনে নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস৷ একমাএ তোর মা’র জন্য এতো বড় একটা ঘটানাতেও আমি চুপ৷ তোর মামা নেহাৎ সিলেটের বাইরে গেছে কাজে৷ আর এইটা ফ্লাইটের টিকিট আমি নতুন করে আজকের ডেট বলে ম্যানেজ করেছি৷ ‘

–‘ নীতুর যাওয়ার ব্যবস্থা করো৷ ‘ উনি শান্ত ভাবে উত্তর দিলেন৷ আমি চমকে উঠলাম সাথে ফুঁপিও৷ ফুঁপা রেগে গেলেন৷ বললেন,

–‘ নির্লজ্জদের মতো কথা বলছিস কেন? তোকে বলা হয়েছিলো, নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করতে৷ আর নীতু কেন যাবে? ওর পড়াশোনা আছে৷ ‘

উনি চোখ তুলে তাকালেন না৷ ফুঁপি শান্ত ভাবে বলল,

–‘ কাব্য, রুমে যাও! তোমার অন্যায় আবদার মেনে নেওয়া সব সময় পসিবল না৷ ‘

তিনি গেলেন না৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

–‘ নীতুর যাওয়ার ব্যাবস্থা করেই আমি যাবো৷ তার আগে না৷ ‘

ফুঁপা রেগে উঠে দাঁড়ালেন৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

–‘ ও যাবে না তোমার সাথে৷ সব কিছুর একটা নিয়ম থাকে কাব্য৷ আর বিয়েটা ঝামেলার মধ্যে হয়েছিলো তাই মেনে নিয়েছি আমরা৷ এখন পাগলামী করে লাভ নেই৷ ‘

উনি কারো কথার উত্তর না দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ স্থির কন্ঠে বললেন,

–‘ তোর যাওয়ার ব্যাবস্থা করলে তুই যাবি আমার সাথে?’

উনার কথা শুনে সবার মুখের দিকে তাকালাম৷ মাথা নীচু করে বললাম,

–‘ আপনার যাওয়াটা দরকার৷ কারণ আপনার সপ্ন ওইটা৷ ‘

 

আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি ফাইল উঠিয়ে বললেন, ‘ ওকে ফাইন! ‘

আহত শরীর নিয়েই বাইরের দিকে পাঁ বাড়ালেন৷ কালকের প্যাক করা লাগেজ নিচেই ছিলো৷ ওই গুলা একহাতে দ্রুত টেনে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়৷ ফুঁপি আর আমি উনার পিছু পিছু গিয়েও আটকাতে পারলাম না উনি গাড়িতে উঠেই গাড়ি স্টার্ট দিলেন৷ সত্যি চলে যাবেন? একহাতে ড্রাইভ করবে কি ভাবে? ফুঁপি কাঁদছে আর ফুঁপার সাথে তর্ক করছেন৷ আমি দৌড়ে মোস্তাকিম ভাইয়াদের রুমে গিয়ে সব বলতে তারা বের হয়৷ কান্না পাচ্ছে..! এতো অবুঝ কেন উনি?


#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি

#পার্টঃ২২

#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)

জানালার পর্দা ফাঁকে একটুকরো রোদ গলে রুমের মাঝে পড়ছে৷ রোদের আলো তীর্যক৷ অন্ধকার ঘরে হাঁটু মুড়ে মুখ গুজে বসে আছি৷ রোদটুকরো আমার উপরে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি আবার৷ আজ দুইদিন হয়ে গেছে কাব্য ভাইয়ার কোনো খোজ খবর কেও পায় নি৷ দূর্বল শরীর নিয়ে আমাকে যখন বলেছিলো, ‘ যাবি আমার সাথে? ‘সেই টুকু কথা মনে পড়তেই চাঁপা কান্নার মাএা সারা ঘর ময় তীব্র শব্দে পরিণত হলো৷ কোথায় উনি? কোনো খোজ নেই কেন৷ পাশে থাকা মোবাইলে সময় দেখলাম আটটা বেজে পঁচিশ মিনিট৷ আবার ফোন দিলাম তার মোবাইলে৷ কিন্তু..! কিন্তু..! সেই এক কথা ভেসে আসছে.. মোবাইল অফ৷ অস্থির লাগছে৷ মোস্তাকিম ভাইয়ারা সাথে সাথে গেলেও তার গাড়ি আর পায় নি৷ বারবার ফোন দেওয়া সত্বেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না৷ অজানা এক ভয়ে মনের মাঝে ধুকপুক করছে৷ কিছু হয়ে নি তো? আর চলে গেলে? যদি গিয়েও থাকেন ফোন তো করবেন৷ আমি অস্থির পায়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ চুল এলোমেলো..! এক ড্রেস৷ সেদিনের পর থেকে না খাওয়া৷ ফুঁপিও অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ আব্বু এসেছে..! আমায় হাজার বার ডাকলেও সাড়া দেই নি৷ না খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো৷ টাল সামলাতে না পেরে পড়তেই বেডের কোণায় মাথা লাগতেই তীব্র ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলাম৷ মাথা ঘুরছে..! চোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠছে৷ আমার চিৎকারে বাইরে রাহুল ভাইয়া, জিনিয়া ছুটে এসেছে৷ দরজা ধাক্কাচ্ছে৷ উঠে খুলে দেওয়ার বা মুখে বলার শক্তি যোগাতে পারলাম না৷ মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে শুধু বললাম, ‘ আমি আপনার সাথে যাবো..! কোথায় আপনি? আপনাকে ছাড়া যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি৷ আমি কথা শুনবো, প্লিজ আমার কাছে ফিরে আসুন৷ ‘

________________________

— ‘ নীতু, এই নীতু..! ‘

ক্ষীণ স্বরে কেও একজন ডাকছে৷ আমি ঘুমের ঘোরেই, ‘ হু ‘ বলতে কঁপালে উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম৷ শান্তির বাতাস বয়ে গেলো৷ এ যে তার ছোঁয়া..! কাব্য ভাই৷ চোখ খুলতে চেয়েও পারলাম না৷ চোখ বন্ধ করেই শুয়ে আছি৷ আবারও সেই স্নিগ্ধ আওয়াজ,

–‘ এতোটা অবুঝ কেন তুই? আমি কি চাই বুঝিস না? ‘

উত্তর দিলাম না৷ হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে চাইলাম৷ তার হাতের উপর হাত পড়তেই আলতো ভাবে আঁকড়ে ধরেন৷ আবার থমথমে গলার আওয়াজ,

–‘ আমি যে তোর মাঝেই থাকতে চাই৷ বি স্ট্রং..!’

আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম৷ থেমে থেমে দূর্বল গলায় বললাম,

–‘ আপনি আমায় কেন বুঝেন না? আপনাকে ছাড়া আমার থাকতে কেন কষ্ট হয় বলতে পারবেন? আপনার মাঝে এতোটা ডুবে কি করে গিয়েছি? আপনি জানেন..! আমি দুটো দিন চোখের পাতা এক করতে পারি নি৷ এতো কষ্ট কেন হচ্ছিলো আপনার খোজ না পেয়ে? ‘

উনি বোধহয় সেই মন মাতানো হাসি হাসলেন৷ আমি চোখ বন্ধ করেই সেই হাসি যেন দেখতে পাচ্ছি৷

–‘ তোকে ছাড়া আমি কি করে যেতে পারি বল তো? তুই ছাড়া আমি অচল যে..! ‘

আমি অনুরোধের গলায় বললাম,

–‘ আমি যাবো আপনার সাথে৷ আমায় ফেলে যাবেন না..! আপনাকে না দেখলে যে আমার বুকের মাঝে কষ্ট হয়৷ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে৷ মনে হয় মরেই যাবো৷ ‘

আমার ঠোঁটের উপর তার হাতের ছোঁয়া পেলাম৷ উনি রাগমিশ্রিত গলায় বলল,

–‘ আমার মাঝে এতো টা বিভোর হলি কবে? আমার চেয়ে তুই বেশি বিভোর তা কি জানিস? তুই তো আমার ভালোবাসার চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিস৷ ‘

আমি উনায় আবার আঁকড়ে ধরতে চাইলাম৷ পাশে জিনিয়ার কথা শুনেই চোখ খুলে তাকালাম৷ জিনিয়া আমায় বলছে,

–‘ আপু..! ঠিক আছিস তুই? ‘

চোখ খুলতেই একঝাক ব্যাথা আমার মাথা সহ চোখেমুখে আছড়ে পড়লো৷ আমি মাথায় হাত দিতেই ও হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

–‘ মাথায় হাত দিস না..! ব্যান্ডেজ করা৷ আর ওইভাবে পড়লি কি করে আপু? জানিস আমরা কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷ ‘

আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললাম,

–‘ উনি কই? জিনিয়া উনি কই? আমি উনাকে দেখবো৷ মাএ আমার কাছে ছিলেন৷ কোথায় গেলেন উনি? আমার কাছে আসতে বল৷ আমি যাবো উনার সাথে৷ ‘

–‘ মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না এখনো৷ ও যায় নি কোথাও৷ কারণ ওর নাম নেই ফ্লাইটের৷ তোর ফুঁপা আর মোস্তাকিম ওরা খুজছে৷ ‘

ফুঁপি আমার পাশে এসে বসে বলল৷ আমি আবার কেঁদে ফুঁপির হাত ধরে বললাম,

–‘ ফুঁপি..! আমি যাবো৷ প্লিজ তুমি আব্বু আর ফুঁপাকে বুঝাও৷ আমার যে কষ্ট হচ্ছে৷ ‘

ফুঁপি নিজের চোখের পানি মুছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

–‘ হ্যাঁ, কাব্য আসুক ওকে মারবো তারপরে তোকে আর ওকে একবারে বেঁধে দিবো৷ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ,কি হাল বানিয়েছিস৷ স্যালাইন আরো একটা দেওয়া লাগবে এতোটা দূর্বল হয়ে গেছিস৷ ‘

সপ্নে এসেছিলো সে৷ তাকে অনুভব করছি সব সময়৷ আর ফিরিয়ে দিবো না আপনাকে৷ কিন্তু আপনাকে লাগবে আমার৷ কোথায় পাবো আপনাকে?

 

মাথা ব্যাথা হালকা হয়েছে৷ এখন নিজেকে আরো পাগল পাগল লাগছে৷ বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা নেমেছে৷ পাখিরা নীড়ে ফিরছে৷ এই পাখিদের মতোই উড়ে চলে আসুন না কাব্য ভাই৷ আমার যে আপনাকে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ শুয়ে শুয়ে কাঁদছি৷ হঠাৎ সামনের ড্রেসিং টেবিলের উপর যত্ন করে রাখা ডায়েরি নজরে পড়তেই কিজন্য যেন মনে হয়, হয়তো কোথায় গিয়েছে সেটা পাবো৷ আমি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াই৷ ডায়েরি হাতে নিতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ সে জার্মান এখনো যায় নি৷ তারমানে তাকে পাবো৷ আমি ডায়েরিটা নিয়ে বেডে বসে পড়লাম৷ প্রথম পাতা উল্টতেই তার সুন্দর হাতের লিখা গান,

~ ” ভালোবাসার মোহনায়, ভালোবাসার মোহনায়,

অনুভূতির যাতনায়, তুমি আছো প্রিয় আমার মোহনায়..! ”

~” অকারণের ভালোবাসায়.. বেঁধেছি তোমায়..!

এই অবেলায়..! ”

এসেছিলে কোনো এক বেলায়…

ভালোবাসার মোহনায়….! ”

~ ” ভালোবাসি প্রিয়,ভালোবাসি প্রিয়,

তোমার মাঝের ভালোবাসায়…! ”

তার লিখা হাত বুলিয়ে দেখলাম৷ তার ছোঁয়া আছে এতে৷ কান্না পাচ্ছে৷ চোখ মুছে নতুন পাতা উল্টাতেই আমার পাঁচ বছর আগের ঘুমন্ত একটা ছবি }পেলাম৷ তার নীচে লেখা,

সপ্নের মতো বাস্তব তুই নীতু..! তোর প্রতি অন্যধরণের ফিলিংস কাজ করে কেন আমার? তবে তুই তো পিচ্চি৷ আমার হঠাৎ করে ভালোলেগে যাওয়া প্রেম তুই৷ তোর মাঝে আমি রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি খুজে পাই৷ এই জানিস তুই? আমি প্রেম খুজে বেড়াই তোর মাঝে৷

আমি সুপ্ত হাসলাম৷

” প্রেম হয় ধীরে ধীরে, তবে ভালোবাসা সেটা তো সারাজীবন বেঁধে রাখার সম্পদ৷ ”

হ্যাঁ,তার লিখা কথাটা বাস্তব৷ প্রেম হয় ধীরে ধীরে৷ সেই প্রেমে সুপ্ত বাসনা থাকে৷ আঁকড়ে রাখার প্রেরণা থাকে৷ এই জন্যই তার মনে আমার জন্য উঁপচে পড়া প্রেম আছে৷ সেটা অনেক আগের থেকেই তার মাঝে সে পুষে রেখেছে৷

ডায়েরি হাতে নিয়ে উঠতেই একটা কাগজ উড়ে যায়৷ আমি ডায়েরি রেখে সেটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি,

” এই জানিস? তোকে কেন ডায়েরি দিয়েছি?আমি কখনো হুট করে হারিয়ে গেলে আমায় যেন খুজে পাস৷ আমি তো তোর কাছে, তোর পাশে থাকতে চাই৷ হারিয়ে গেলে খুজবি অচেনা শহরে৷ তোর মনের অচেনা শহরে৷ সেখানে আমায় পাবি৷ হাত বাড়িয়ে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবো৷ তুই বোকা..! বড্ড বোকা৷ আমি হারিয়ে গেলে কেঁদে কেটে সমুদ্র বানাবি৷ ইশ! তুই পাগল৷ আমি যে তোকে ছাড়া থাকতেই পারি না৷ সে আবার হারিয়ে যাবে এইটা কখনো হয়? ”

আমার মনের মাঝে হাজার প্রজাতি ডানা মেলে উঁড়ে গেলো৷ ইশ! সত্যি আমি বড্ড বোকা৷ সে আছে৷ আমার মনের অচেনা শহরে৷ আমি কাগজ হাতেই দৌড়ে বের হয়ে এলাম ঘর ছেড়ে৷ এখন মাথা ব্যাথা করছে না একদম৷ সে আছে..! আমি তাকে দেখতে পাবো৷ আমাকে দৌঁড়ে বের হয়ে আসতে দেখেই ফুঁপি আর জিনিয়া এগিয়ে এসে আমায় ধরে শাসনের সুরে বলল,

–‘ কোথায় যাচ্ছিস? তোকে রেস্ট নিতে বলেছে৷ ‘

–‘ তোমার অবাধ্য ছেলেকে খুজতে৷ প্লিজ বারণ করো না৷ আজ তাকে নিয়েই ফিরবো৷ ‘

আমার হাসি মুখ দেখে ফুঁপি মনে হয় ভরসা পেলো৷ আমাকে ছেড়ে দিতেই আমি আবার দৌড়ে আবার বেরিয়ে যাই৷ তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা৷ ভার্সিটির পাশের রিসোর্ট৷ আমি সিউর সেখানেই উনি আছেন৷ এইটা কি করে ভুলে গেলাম আমরা৷ সে রাগ করে ওইখানেই চলে যায়৷ আমি রিক্সা নিতে চেয়েও নিলাম না৷ তাড়াহুড়োতে টাকা আনি নি৷ কাব্য ভাইয়াদের বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে কতক্ষণ লাগে আমি জানি না৷ আমি শুধু হাটছি৷ মাঝে মাঝে মাথা চেঁপে দৌড়ে যাচ্ছি৷

রিসোর্টের সামনে এসে হাঁফ ছাড়লাম৷ মাথা আর পাঁ ব্যাথায় টনটন করছে৷ আমি গেইট দিয়ে ঢুকলাম৷ রিসেপশন থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কাব্য মেহেরাজ এসেছে কি না৷ ‘ উনারা জবাব দিলেন না৷ বুকের মাঝের শূন্যতা আবার ছাঁপিয়ে পড়লো৷ তার মানে আমি কি ভুল? একজন আমার পাশে এসে বলল,

–‘ বাগানের সাইডে কেও একজন আপনার অপেক্ষায় আছে৷ ‘

আমার মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো৷ তারমানে সে আছে৷ আমি মুচকি হেসে পাঁ বাড়ালাম৷ আমি নিজে থেকে তাকে বলবো আজ,

–‘ আমায় কি আপনার প্রেমের বৃষ্টি বানাবেন? শুধুই প্রেমের বৃষ্টি৷ যেখানে রোদ থাকলেও স্নিগ্ধতা থাকবে৷ ‘

বাগানের দিকে যেতেই সব লাইট গুলো হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেলো৷ আমি ভয় পেলেও এগিয়ে গেলাম৷ হুট করেই আবার একঝাক আলো জ্বেলে উঠলো৷ আমি চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম৷ পিটপিট করে চোখ খুলতেই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পাবো সত্যিই ভাবতে পারি নি…!

 

শেয়ার করুন