#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৩৫
#রুবাইদা_হৃদি
পশ্চিমের মৃদু হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ চুল গুলো হাওয়ার তালে দোল খাচ্ছে৷ চোখেমুখে আছড়ে পড়া চুল গুলো কেও একজন যত্ন করে গুজে না দিয়ে থেমে থেমে এলোমেলো করে দিচ্ছে৷ পেছন থেকে জড়িয়ে রাখা হাত দুটো ইচ্ছা করেই যে পেটের মাঝে স্লাইড করছে সেটা খুব করে বুঝতে পারছি৷ বিরক্তি তে আছড়ে পড়লেও সামলে নিচ্ছি৷ সব কিছু বাদ দিয়ে, চব্বিশ ঘন্টার বেড়াজালে খুব করে ফেঁসে গিয়েছি৷ হাতের স্পর্শ গাঢ় হতেই আমি কেঁপে উঠলাম৷ তার হাতের উপর হাত রাখতেই সে ঘাড়ে ঠোঁট ছোয়ায়৷ অফিসের রুমে দাঁড়িয়ে কাজ ফেলে সে রোম্যান্সে ব্যাস্ত৷ আমি তার হাতে চিমটি দিতেই সে আরো আঁকড়ে ধরলেন৷ ফিসফিস করে বললেন,
–‘ সবে মাত্র দশ ঘন্টা হয়েছে বউ৷ ‘
–‘ তো..! ‘
আমি কাঁপা ভাবে বলতেই উনি আমাকে সামনে ঘুরিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললেন,
–‘ তো..! মিসেস চব্বিশ ঘন্টা আশেপাশে থাকতে চেয়েছে৷ এর মানে সে আমার কাছে..!’
আমি তার ঠোঁটের উপর হাত দিয়ে আটকিয়ে দিলাম৷ লোকটা বড্ড বেহায়া৷ আশেপাশে থাকার মানে এইসব৷ উফফফ..! হাতের মাঝে আবার৷ আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম৷ হাত সরিয়ে নিতেই উনি হাসলেন৷ তার হাসিতে দুষ্টুমি ভরা৷ আমি নিজেই এবার সেদিনের মতো কাজ করে লজ্জায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ সে এখনো ফ্রিজড৷ আমি তার হাতের বাঁধন আলগা পেতেই উনার চেয়ারে বসে পড়লাম৷ উনি এখনো ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি কলম আর ফাইল নিয়ে তার মতো করে বললাম,
–‘ হেই মিস্টার কাব্য.. কাজ ফেলে কি করছেন ওইখানে৷ কাম হেয়ার ইউ ইডিয়ট৷ ‘
উনি ভ্রুকুটি করে তাকালেন৷ আমি ফাইল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম৷ তার চোখে চোখ মেলাতে পারবো না৷ উচ্ছ্বাস আবেগ ঠিকরে পড়বে যে৷ উনি বোধহয় হাসছেন৷ আমি ফাইল সরিয়ে ফেলতেই সামনে উনাকে পেলাম না৷ পেছনে থেকে নিশ্বাসের শব্দের উৎস পেতেই আমি উঠে যেতে নিলাম৷ সে চেয়ারে বসে একটানে আমেকে কোলে বসিয়ে নিলেন৷ তারপর, ফাইল টেবিলে রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ আমি ঘোর কাটাতে পারছি না৷ হলো কি? সে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন৷ আমি উঠে যেতে নিলেই উঠতে না দিয়ে আটকে ফেললেন৷ বললেন,
–‘ তোর কথার নড়চড় হতে তো আমি দিবো না৷ একদম না৷ ‘
–‘ ছাড়ুন আমার অস্বস্তি হচ্ছে৷ ‘
উনি কাজ রেখে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সামনে ঝুকে দাঁড়ালেন৷ আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে না গিয়ে চেয়ারে একদম লেগে গেলাম৷ উনি গালে স্লাইড করে বললেন,
–‘ প্রত্যেক টা মূহুর্ত একেকটা মূহুর্তের সাক্ষী৷ শূন্যতা নামক কিছু তোর আশেপাশে আসতেই পারবে না৷ আমি আছি,থাকবো৷ সব সময়৷ সেটা যেভাবেই হোক৷ ‘
আমি চোখ খুলে তার গভীর দৃষ্টির দিকে তাকালাম৷ বললাম,
–‘ জানেন,আপনার শূন্যতা নয় হারিয়ে ফেলার ভয় পাই আমি৷ কেন পাই? বলতে পারবেন? ‘
–‘ রৌদ্দুরে যেমন বৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে, তেমন তোর মনের ভয়ের কারণ বৃষ্টির মতো৷ রৌদ্দুর আর বৃষ্টির খেলায় মিশে যাবে৷ না থাকার ভয় প্রেমের বৃষ্টি নিয়ে নামবে৷ হারিয়ে গেলে,সেই বৃষ্টির ফোঁটায় খুজে বেড়াবি৷ পেয়ে যাবি,আমি তোকে ছুঁয়ে দিবো৷ গ্রহণ করে নিবি মাঝে মাঝের সেই বৃষ্টির ফোঁটা৷ ‘
আমি উনার বুকের সাথে মিশে গেলাম৷ চাই না কোনো বৃষ্টির ফোঁটা আমার যে শুধুই তাকে চাই৷
____________
শীতের আমেজ পড়ছে৷ কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া কাঁচের ফাঁক দিয়ে হালকা কিরণ রুমে ঢোকার জন্য কতশত বাহানা করছে৷ রৌদ্রতপ্ত হয়েও তাদের যাওয়ার জায়গা নেই৷ মিইয়ে যাওয়া লজ্জায় রাঙা নতুন বধূর মতো গাছের পাতা ঝড়ে পড়েছে বহুকাল আগেই৷ সাদা আস্তরণে ঢেকে থাকা একফালি সবুজ কুচি দেখা মিলছে পাতাবিহীন গাছে৷ ঠান্ডায় কেঁপে উঠা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরের শিরায় শিরায়৷ অলস চোখ না খোলার বাহানা নিয়ে যুদ্ধে মেতে উঠছে৷ পাশে থাকা মানুষটার শরীরের উষ্ণ পরশ ঠান্ডার মাঝে অলসতা যেন আরো বাড়িয়ে দিলো৷ ঘুমু ঘুমু চোখে তার সাথে একদম মিশে গেলাম৷ সে দুইহাতে আরেকটু জড়িয়ে নিলেন৷ তাপমাত্রা হঠাৎ করেই নভেম্বরে মাঝে এসে মাইনাস হয়ে গেছে৷ ঠান্ডা জমে যাওয়ার অবস্থা৷ দিন যাওয়ার সাথে ঠান্ডা বেড়ে চলেছে সেই সাথে ভালোবাসার উষ্ণতা৷ চব্বিশ ঘন্টার তিন ঘন্টা তাকে ছাড়া থাকতে হয়৷ আর সেই সময় আমার ভার্সিটির ক্লাস৷ জীবন থেকে সেই তিন ঘন্টা তাকে বিহীন চলে যাচ্ছে ভেবেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো৷ ঘুমের মাঝে হুট করেই শয়াতানি বুদ্ধি মাথা চারা দিয়ে উঠলো৷ অবিশ্রান্ত ভাবে তার বাঁধন থেকে ছুটে টি শার্টের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেলাম৷ আমার ঠান্ডা হাতের স্পর্শে তার ঘুম ছুটে গেছে৷ উনি কঁপাল কুঁচকে আমাকে তাও জড়িয়ে আবার ঘুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন৷ আমি নিজের হাত দুটো বের করে ঠান্ডা করে নিলাম৷ তারপর উনার পিঠের উপর স্লাইড করতেই হুড়মুড় করে চোখ খুলে ধমকে উঠেন আমায়৷ হঠাৎ করেই মন খারাপেরা হানা দিলো৷ আমি গুটিশুটি ভাবে সরে আসতে গেলেই উনি সরে আসতে দিলেন না৷ ওইভাবে জড়িয়ে রাখলেন৷ আমি মন খারাপ করে বললাম,
–‘ ক্লাস আছে৷ আমি উঠবো৷ ‘
–‘ আজ সানডে৷ ‘ উনি স্লো ভয়েসে বললেন৷ ধমকের সুর কানে বাজছে৷ তাই আবারও উঠতে চাইলাম৷ উনি জেদি৷ আমার চেয়ে বেশি৷ দিবেন না মানে না৷ আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ ঠান্ডাময় সকালে উষ্ণতায় ঘেরা পরশ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া তো ঘোর অন্যায়৷ ‘
আমি অভিমান করে বললাম,
–‘ অন্যায় টন্যায় জানি না৷ বকেছেন আমায় সেই খেয়াল আছে? ‘
–‘ বকেছি বুঝি? ‘
–‘ মনে করুন৷ ‘
–‘ মহারাণী রাগ করেছে? ‘
আমি নিজের ঠান্ডা হাত তার গালে ছুইয়ে দিয়ে খিলখিল করে হেসে বললাম,
–‘ রাগ নেই৷ ‘
উনি ভ্রুকুচকে ফেললেন৷ ঠান্ডা হাতের ছোঁয়াতে উনার শরীরে জারকাটা দিয়ে উঠলো৷ আমি হেসে চলেছি৷ অবিরাম৷ উনি নিজেও হেসে ফেললেন৷
রৌদ্রউজ্জ্বল দিনের শেষভাগ ছাপিয়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বরফের আভাস পেলাম৷ ডিভানে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো৷ তার সাথে বৃষ্টির ফোঁটার মতো তুষার৷ আমি একলাফ দিয়ে উঠলাম৷ জীবনের প্রথম৷ বর্ষার সময় বর্ষা দুপুরে আকাশ ভেদ করে যেমন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিরা মেতে উঠে ঠিক তেমন টা৷ দৌড়ে সামনের ইয়ার্ডে গেলাম৷ উত্তাল ভাবে তুষার পড়ছে৷ উনি অফিসে৷ এখনো ফেরেন নি৷ আমি আবার রুমে গিয়ে জিনিয়া কে ফোন দিলাম৷ পাগল প্রায় অবস্থা৷ স্নো গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে আমাকে৷ আমি দু হাতে তাদের বরণ করে নিচ্ছি৷ ঠান্ডা লাগলেও সেটা পাত্তা দিচ্ছি না৷ জিনিয়া ফোন ধরতেই ওকে ভিডিও কলে সব টা দেখালাম৷ ও পারলে এখুনি চলে আসবে৷ আমি হাসছি৷ প্রাণ খোলা হাসি৷ কিছু মূহুর্তে সামনের পুলের পানি জমে বরফে পরিণত হলো৷ গাড়ির আওয়াজ পেতেই আমি দৌড়ে পার্কিং এরিয়া তে যাই৷ উনি গাড়ি থেকে নামতেই আমি উৎফুল্ল ভাবে উনাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বললাম,
–‘ স্নো..ইশ! কতো সুন্দর৷ চলুন আমরা হাটি৷ এতো সুন্দর আমি আগে দেখি নি৷ ‘
–‘ সোয়েটার কই তোর? ‘
উনার গম্ভীর আওয়াজে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সোয়েটারের ” স ” ও নেই৷ হঠাৎ করেই ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো৷ আমি কেঁপে উঠলাম৷ সাথে তার গম্ভীর দৃষ্টি৷ স্নোফলের মতো ধমক ঝড়বে ভেবেই তার সাথেই জড়িয়ে গেলাম৷ ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছি৷ উনি ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উন্মনা ভাবে বললেন,
–‘ কবে বড় হবি তুই?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
–‘ ব..বড় ত তো হয়েই গেছি৷ কয়েকদিন পর চানকু মানকু আসবে৷ আর আপনি এখনো কবে বড় হবো ভাবছেন৷ ‘
–‘ চানকু মানকু৷ হোয়াট দ্যা হেল৷ কি ধরণের ভাষা এইগুলা৷ ‘
আমি নিজের কেঁপে ওঠা ঠোঁট জোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তার সাথে আরো মিশে গিয়ে বললাম,
–‘ আমি রাতের আঁধারে স্নো এর উপর হাটবো৷ এইটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছা৷ ‘
–‘ টেনে এক থাপ্পর মারবো ফাজিল৷ কি ধরণের ইচ্ছা এইগুলা?
–‘ আ আ আ..! ‘ ঠান্ডার শিহরণের জন্য জমে যাওয়ার অবস্থা৷ মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করে আটকে গেলাম৷ উনি নিজের জ্যাকেট খুলে আমায় পড়িয়ে দিলেন৷ তারপর একটানে কোলে উঠিয়ে বাসার দিকে পাঁ বাড়ালেন৷ কিছু একটা বিরবির করছেন উনি৷ আমি শুধু বলছি,
–‘ আমি স্নো এর উপর হাটবো৷ আপনি কথা শুনেন না৷ আমার কথার গুরুত্ব দেন না৷ ‘
উনি আমার হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে ঘষছেন৷ ঠান্ডায় জমে গিয়েছে৷ বোধ পাচ্ছি না একদম৷ ছোট ছোট চোখ করে উনার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে আছি৷ প্রচুর রেগে গিয়েছেন৷ আমি হাত ছাড়িয়ে উনার গলা জড়িয়ে ধরলাম৷ আবারো কেঁপে ওঠা ঠোঁট দিয়ে উনার গালে পরশ দিয়ে বললাম,
–‘ ভালোবাসা ময় সর্যি৷ আর হবে না এমন৷ ‘
উনি গম্ভীর ভাবেই আমাকে টেনে নিলেন৷ বাইরে বর্ষার দুপুরের মতো তুষারের আনাগোনা৷ আর উত্তাল পরশের ছুটোছুটির ভীরের ভালোবাসার পরশ৷
_____________________
ক্লাসের হলরুম টু ক্যান্টিন৷ একবার দৌড়ে ক্যান্টিনের সামনে জমে থাকা বরফের উপর লাফাচ্ছি তো আরেকবার ক্লাসের সামনে জমে থাকা বরফের স্তূপের উপর৷ রাতিব আর জেন হাসিতে ফেটে পড়ছে৷ তাদের মতে, আমার করা কাজগুলো নিছক পাগলামী৷ ভাগ্যিস মিস্টার. কাব্য তার ভার্সিটি তে৷ আমার কথা ভুল প্রমাণ হলো কারো হাতের টানে৷ আমি ভয়ে সিটিয়ে গেলাম৷ শুকনো ঢোক গিলে রাতিবের দিকে তাকালাম৷ ও হাত দিয়ে ইশারা করলো, ‘ তুমি ফিনিশড৷ ‘
রাগী চোখে ভাষা নিমিষেই চুপসে গেলাম৷ আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে৷ তারপর ছুড়ে মারলেন একপ্রকার৷ ভয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না৷
রোজ ভিউ..! অপূর্ব সৌন্দর্যের একটা ছোট কটেজ৷ বার্লিনের মেইন শহরের কিছুটা দূরে অবস্থিত ব্ল্যাক ফরেস্ট৷ সেখানের খোলামেলা জায়গায় পাহাড়ের ঢালুর নিচে ছোট একটা কটেজ এইটা৷ সামনেই পাহাড়ের নিচে সমুদ্রের পানির আভাস দেখা যাচ্ছে৷ কটেজের সামনে লাল কার্পেট বিছানো৷ আর তার পাশেই বরফের উপর ছোট ছোট লাইটের ভীর৷ সন্ধ্যে না নামলেও সূর্যের দেখা না পাওয়ার জন্য হালকা আঁধার নেমেছে৷ কটেজের বাইরের এরিয়া পুরো বরফ আর লাইট দিয়ে ঘেরা৷ উনি আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে গেলেন৷ ছোট বাগানের মতো অংশে হাজার লাল গোলাপ আর বরফে ঢাকা রোজ ভিউয়ের নেমপ্লেট৷
–‘ তোমার নামের বসন্ত নামুক আমার বুকের
মাঝে৷ ‘
আমি অবাক চোখে তাকালাম৷ উনি মুচকি হেসে বললেন,
–‘ বসন্তের সময় জায়গাটা নিজের সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তুলে৷ যদিও এই সময়ে বরফের স্তূপে ঢেকে সাদা তুলোর ন্যায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে৷ তোর বরফে ঢাকা রোজ ভিউ আর আমার বসন্তের ছোঁয়ার রোজ ভিউ কোনটা বেশি সৌন্দর্য প্রকাশ করে সেটা দেখার বাকি৷’
আমি উনার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
–‘ সেটা বসন্ত আসলে দেখা যাবে৷ কিন্তু হঠাৎ এখানে? ‘
–‘ সারপ্রাইজ৷ ‘ উনার বলা কথার সাথে আবারো গুড়ি গুড়ি বরফ পড়ে আমাদের স্বাগতম জানালো৷ আমি খুশিতে আবারো পাগল প্রায় অবস্থা৷ বার্লিনের প্রত্যকটা দিন এতো সুন্দর হবে আমি ভাবতেই পারি নি৷ সাধারণ একটা দিন অসাধারণ হয়ে উঠেছে৷ রাতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বাইরে বসে তার গলার গান আরো বিমোহিত করে তুলেছে৷ অচেনা এই শহরের বরফ ঢাকা রোজ ভিউয়ে তে বাংগা গানের স্বাদ হঠাৎ করেই নিজে থেকে তার কাছে যাওয়ার আভাসে টানলো৷
_____________
তার বুকের মাঝে প্রশান্তির ছায়া আছে৷ সকাল নেমেছে অনেক আগেই৷ আমি উঠে ব্ল্যাক কফি করে তার কোলে বসে পড়লাম৷ উনি আমাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে কফি খাচ্ছেন৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি সন্ধিহান গলায় বললেন,
–‘ কি হয়েছে? ‘
–‘ একটা সিরিয়াস কথা৷ ‘
আমি উনার সামনে ঘুরে তার হাত আমার পেটের উপর নিয়ে বললাম,
–‘ আমার বেবি চাই৷ ‘
আমার কথা শুনে কেশে উঠলেন উনি৷ কফি সাইডে রেখে সিরিয়াস ভাবে বললেন,
–‘ আজগুবি কথা কে ঢুকিয়েছে তোর কানে৷ কবিতা আপু? ‘
–‘ উহু,,আমি নিজেই৷ ‘
উনি আবার কফি খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন৷ আমি চুপ করে আছি৷ নীরবতা ঠেলে উনি বললেন,
–‘ দেখা যাবে৷ তবে কিছুটা সময় পরে৷
তার কথায় লজ্জায় পড়ে গেলাম৷ সত্যি মেনে নিলেন এতো সহজে?কেমন সন্দেহ হচ্ছে৷ এতো সহজে কেন মেনে নিয়েছিলেন সেই সন্দেহ বাস্তবতায় রুপ নিলো বাসায় ফেরার পর৷ সব তো ঠিক ছিলো৷ এইভাবে কি ছিন্নভিন্ন না হলে হতো না? সুখের মূহুর্তের পর সবচেয়ে কষ্টের মূহুর্ত তো বাসায় ফেরার পর থেকে শুরু হয়েছিলো….!
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৩৬
#রুবাইদা_হৃদি(sheikh ridy)
ঝড়ো হাওয়ার মতো জীবনের পাতায় যখন উত্তাল বাতাসের দাপট আসে তখন জীবনের মানেটা হঠাৎ করেই থমকে যায়৷ সব কিছুর আগে একটুকরো আশার আলো থাকলেও হয়তো কিছু সময় সেটাও থাকে না৷ গাড়িতে মন উদাস করে বাইরে ঝড়ো হাওয়া দেখে চলেছি৷ কিছু একটা হয়েছে যার জন্য,রোজ ভিউ থেকে এই রাতের আঁধারে উনি চলে এসেছেন৷ হঠাৎ করেই সে চুপসে গিয়েছে৷ আমি তার দিকে তাকালাম উনি ড্রাইভ করছেন৷ আমি তার হাতের উপর হাত রাখতেই সে আমার দিকে তাকালো৷ তার চোখ দুটো অসম্ভব লাল৷ ভয় করছে হঠাৎ৷ বাসায় ফেরার জন্য কিসের তাড়া এতো৷ আমি নীচু স্বরে বললাম,
–‘ কি হয়েছে? ‘
–‘ ইমিডিয়েটলি বাসায় ফিরতে হবে৷ ‘ উনি নিজেও মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললেন৷ কিছু একটা আছে যা খারাপ৷ হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে৷ উনি আমার হাত উঠিয়ে দিলেন৷ আমি নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ বুকের মাঝে অজানা সুর গাইছে৷ কি এমন হয়েছে! যার জন্য সমস্ত কিছু ফেলে ছুটে চলে আসছি আমরা?
–‘ বি স্ট্রং৷ ‘
তার কথার আওয়াজে ঘোর ভাঙলো৷ বাসায় এসে পড়েছি৷ হাত বাড়িয়ে দিলেন উনি আমি নেমে দাঁড়ালাম৷ তার হাঁত ঠান্ডা৷ আমি কেঁপে উঠে তার দিকে তাকালাম উনি বাসায় যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন৷ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি৷ উনি নিজেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন৷ আমি তার সাথে পায়ে পাঁ মিলিয়ে যাচ্ছি৷ প্রশ্ন করলাম,
–‘ দেখুন..! আমি সব মেনে নিতে পারি কিন্তু নীরবতা না৷ কি হয়েছে বলবেন কি? ‘
–‘ যাচ্ছি তো৷ তবে যা হয়ে যাক তুই স্ট্রোং থাকবি৷ আর মাথায় রাখবি, আমি আছি৷ ‘
আমার বুকের মাঝে আমার ভয় এসে জমা হলো৷ কি হবে?কি হয়েছে? এই সব প্রশ্নে ভারী হয়ে উঠছে আমার মন৷ বাসায় ঢোকার আগে আরেকটু অবাক হলাম কারণ,মেইন গেইট খোলা৷ উনি তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়েই রুমে এলেন৷ ঘরময় অন্ধকার৷ আমাদের রুমে থেকে আওয়াজ আসছে৷ চাঁপা কান্নার আওয়াজ৷ ভড়কে গেলাম আরো৷ কে কাঁদছে এইভাবে? আমাদের চেনা তো কেও নেই এখানে৷ আমি ভয়ে আরেকটু সিটিয়ে গেলাম৷ অস্থির পায়ে এগিয়ে চলেছি রুমের দিকে সাথে উনিও৷ আবছা আলোয় তার মুখের রঙ পাল্টিয়ে ভয়ের ছাঁপ পড়েছে সাথে বিষাদের৷ রুমে ঢুকেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম কবিতা আপুকে দেখে৷ থমকে দাঁড়ালাম৷ আপু অবিরাম কেঁদে চলেছে৷ আজমীর ভাইয়া তাকে জড়িয়ে রেখেছে৷ কাব্য ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে আপুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আপু বিলাপ করে কেঁদে উঠে৷ উনারা এখানে কিভাবে? আমি দরজা ধরে থমকে দাঁড়িয়ে আছি৷ হঠাৎ আমাকে দেখেই আপু তার ভারী শরীর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো৷ তার কান্না দেখে আমার চোখেও পানি এসেছে৷ আমি অশ্রুসিক্ত চোখে কাব্য ভাইয়ার দিকে তাকালাম উনি মাথা নীচু করে ফেললেন৷ কবিতা আপুকে আমি নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিতেই সে কান্নার সুরে বললো,
–‘ মামু.. মামু নেই নীতু৷ সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷ ‘
আমি ধাক্কা খেলাম৷ মাথায় কেও জোরে আঘাত করলে যেমন চিনচিনে ব্যাথা হয় ঠিক তেমনটা ব্যাথা অনুভব করলাম৷ হঠাৎ করেই পৃথীবি নিস্তব্ধ লাগতে শুরু করলো৷ চারদিকে অন্ধকার হয়ে উঠলো৷ আব্বুর হাসি মাখা মুখ টা হঠাৎ করেই দূরে বহু দূরে যেতে লাগলো৷ চিৎকার করে কান্না আসছে না৷ দম আটকে আসছে৷ চোখ দিয়ে পানি বের হয়েও হচ্ছে না৷ নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে৷ হঠাৎ উনি আমায় ধরতেই আমার সমস্ত কান্না গুলো বেরিয়ে আসলো৷ আব্বুর চেহারা মনে পড়তেই নিজেকে পাগল মনে হলো৷ কিভাবে কি? কোথায় কীভাবে হলো সেটা জানার চেয়ে হঠাৎ করেই মনে হলো উনারা মিথ্যা বলছে৷ আমি চিৎকার করে বললাম,
–‘ ছাড়ুন আমায়৷ মিথ্যা বলছেন আপনারা৷ আব্বুকে নিয়ে মিথ্যা বলতে বুক কাঁপলো না আপনাদের৷ ‘
–‘ নীতু, মামু নেই৷ আজ সকালে হঠাৎ করেই ব্রেন স্ট্রোক করেছে৷ কবিতা আপুরা উইকেন্ডের জন্যই আসছিলো আমাদের এখানে৷ মাঝে আব্বু ওদের ফোন দিয়ে খবর টা দেয়৷ আমার ফোন অফ ছিলো যার জন্য যোগাযোগ করতে পারে নি৷ মোবাইল অন করতেই,আপুর মেসেজ দেখলাম মামুকে আইসিউতে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু আমি সত্যিই জানতাম না মামু নেই৷ ‘
উনার কাঁপা গলার আওয়াজে বলা কথায় হঠাৎ সবকিছু সত্যি মনে হলো৷ কান্না গুলো উঁপচে আসছে৷ আমি ধপ করে বসে পড়লাম৷ হঠাৎ করেই নিজেকে এতিমের খাতায় ফেললাম৷ উনি আমার সামনে বসে দুই হাতে জড়িয়ে নিলেন৷ আমি চিৎকার করে কান্না করছি৷ চারদিকে মানুষজন বিহীন মনে হলো৷ কান্নার ফলে কথা বের হচ্ছে না৷ শুধু উনার কলার ধরে বললাম,
— ‘ আমি আব্বুর কাছে যাবো৷ কেন আমাকে ফেলে চলে গেলো৷ প্লিজ নিয়ে চলুন৷ আমি যাবো৷ ‘
–‘ কাম ডাউন৷ আমি ব্যাবস্থা করছি৷ আম আছি তো৷ আছি আমি৷ ‘
উনার কথাটুকু শুধু কানের মাঝে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে৷ সে থাকলেও আমার আব্বু যে নেই৷ কবিতা আপুর কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি৷ আমার জিনিয়া৷ ছোট জিনয়া ও কেমন আছে৷ মেয়েটা যে কেও নেই৷ আমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছি না৷ উনার চোখেও পানি৷ তার চোখের পানিতে কান্না আরো বেড়ে গেলো৷ আব্বুর থেকে দূরে থাকি নি কখনো৷ ভয় পেয়েছি কিন্তু ছেড়ে থাকতে পারি নি৷ আমার আব্বু,কেন এমন হলো৷ হেঁচকি উঠে গেছে৷ উনার পায়ে ধরে বললাম,
–‘ নিয়ে চলুন৷ আমার আব্বু৷ আমি ছুঁয়ে দেখবো৷ কেন চলে গেলো আমায় ছেড়ে৷ সবাই চলে যায়৷ আম্মুও ছেড়ে চলে গেছে৷ আব্বু কে কেন কেড়ে নিলো৷ আমায় নিয়ে যান৷ আমি বাংলাদেশে যাবো৷ কেন নিয়ে গেলো আমার আব্বুকে? ‘
উনি আমাকে টেনে উঠালেন৷ আমার চিৎকারর ভারী হচ্ছে পরিবেশ৷ আশেপাশের সবাই এসেছে চিৎকার শুনে৷ উনি শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছেন আমার৷ হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া সব ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে৷
________________
মাথার উপর বাবা নামক ছায়ার অভাব মনে হতেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়ছি৷ জিনিয়ার হুশ নেই৷ ওর সাথে কথা বলার মতো অবস্থা যে নেই৷ আমি বিছানার চাঁদর খাঁমচে ধরর কেঁদে চলেছি৷ বুক ফাটা হাহাকার৷ কবিতা আপুর অবস্থা আরো খারাপ৷ খিচুনি উঠে বাবুর প্রবলেম হচ্ছে৷ আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ইতালি থেকে ছুটে এসে নিজেরাই সারপ্রাইজড হয়ে গেছে৷ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন উনি৷ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অনুভূতি শূন্য চোখে৷ আমার অবস্থা হয়তো মেনে নিতে পারছেন না৷আমার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন৷ আমি তার ছোঁয়া পেতেই উনার হাত আঁকড়ে ধরে বললাম,
–‘ নিয়ে যান না আমায়৷ আমি যে মরেই যাবো৷ কতো কথা বলার ছিলো আব্বুকে৷ আমি পারি নি বলতে৷ সেদিন যখন আমাকে বুকে টেনে নিলো তখন তখন…!’
উনি নিজের কান্না আটকানোর জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিলেন৷ আমার মাথা তার বুকের সাথে চেঁপে ধরে বললেন,
–‘ সবাই সবার সাথে চিরজীবন থাকে না নীতু৷ তোকে শক্ত হতে হবে৷ মামুর জন্য দোয়া করতে হবে৷ ‘
–‘ আমি যে পারছি না৷ আমায় নিয়ে চলুন৷ আমি যাবো৷ আমার জিনিয়া যে আব্বুর লাশ দেখে পাগল হয়ে যাবে৷ ‘
–‘ ইমার্জেন্সি টিকেট পাচ্ছি না কাব্য৷ ‘ আজমীর ভাইয়া বললেন রুমে ঢুকতে ঢুকতে৷ কাব্য ভাইয়া উদাস চোখে তাকালেন৷ আমায় জড়িয়ে রেখেই মিনতির সুরে বললেন,
–‘ দুলাভাই দেখেন একটু৷ কবিতা আপু আর ওকে সামলানো দায় হয়ে যাচ্ছে৷ ‘
–‘ সাত দিন পরের টিকিট পেয়েছি তাও একটা৷ এতোদিন পর্যন্ত লাশ রাখা যে আজাব হবে৷ ‘
আজমীর ভাইয়ার কথা শুনে কান্নার পরিমাণ বেড়ে গেলো আরো৷ শেষ আশাও কি পূর্ণ হবে না৷ আমার আব্বুকে দেখতে পাবো না? ভেবেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো৷ ওইতো সামনে আব্বু দাঁড়িয়ে হাসি মাখা মুখে আমায় ডাকছে….!
সব কিছুর পরে একটা কষ্টের অধ্যায় থাকে সেইটা আমি পার করছি৷ আমি সেই সন্তান যে,আব্বুর লাশ শেষ দেখাটাও দেখতে পারি নি৷ আজ সাতদিন পার হয়ে গেছে আব্বু মারা যাওয়ার৷ ডুকরে কেঁদে উঠছি৷ উনি ক্লান্ত পায়ে আমার পাশে এসে বসলেন৷ আমার দৃষ্টি সামনে স্থির৷ হয়তো এখানে না আসলে আমি আব্বুকে দেখতে পারতাম৷ আজ বাসায় মিলাদ পড়ানো হচ্ছে৷ আমি নামাজ পড়ে চুপ মেরে বসে আছি৷ শুধু মনে হচ্ছে, আমি অপরাধী৷ উন্মনা ভাবে বললেন,
–‘ সব কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে শিখ৷ ‘
আমি জবাব দিলাম না৷ উনি আমাকে টেনে নিলেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ চোখের পানি আবার গড়িয়ে পড়লো৷ উনি আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
–‘ মামু নেই..! কখনো আমিও ছেড়ে চলে যেতে পারি৷ নিয়তিতে কি লেখা আছে সেটা আমরা কেও জানি না৷ ‘
–‘ আমি যে মরে যাবো৷ ‘
–‘ মরে গেলে তো ভালোই৷ কিন্তু,বাঁচতে হয়৷ সব সময় সবাই থাকবে না পাশে৷ সব কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখ৷ ‘
উনি চুপ হয়ে গেলেন৷ কিছু ফোঁটা পানি আমার মাথায় পড়লো৷ নিঃশব্দের কান্নার সুর গুলো করুন৷ ঠিক তেমনটা৷ আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় আছি৷ প্রিয় মানুষ গুলো হারানোর বেদনা ছুটে চলে রাতের আঁধারেও৷ শক্ত হতে হবে৷ সব কিছুর বিনিময়ে নিজেকে ঠিক রাখতে হবে৷ পাশে থাকা মানুষটার চেহারাটা দেখে হলেও আমি সব পারবো৷ সত্যি পারবো কি?
#রৌদ্দুরে_প্রেমের_বৃষ্টি
#পার্টঃ৩৭
#রুবাইদা_হৃদি
” ভালোবাসি ” আর ” ভালোবাসা ” দুইটা শব্দ আলাদা৷ এক অর্থ বহন করলেও সবটা যে এক না৷ দিন চলে যাচ্ছে৷ আব্বুকে হারানোর আজ দশতম দিন৷ ব্যাক ইয়ার্ডে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ কাঁধে গরম হাতের ছোঁয়া পেতেই আমি দূরে সরে যাই৷ নিজেক গুটিয়ে রাখছি৷ কেন রাখছি জানি না৷ তবে তার সাথে কথা বলতে আমার একদম ভালো লাগছে না৷ আমার কাধে আবার হাতে ছোঁয়া পেতেই গম্ভীর ভাবে বললাম,
–‘ একা থাকতে দিন৷ ‘
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার শব্দ কানে এলো৷ আবার দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়? এই একটা প্রশ্ন ছেলেবেলার মতো ঘুরেফিরে বেড়ালো৷
–‘ রুমে চল৷ ‘
–‘ যাবো না আমি৷ আপনি যান৷ ‘
আমার ভাবেলাশীন উত্তর শুনে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন উনি৷ মৃদু স্বরে বললেন,
–‘ জিনিয়ার সাথে কথা বলবি? ‘
–‘ কি বলবো? যে তোর আপু ভালোবাসার সাগরে ডুবে আছে এর জন্য আসতে পারে নি? ‘
হঠাৎ করেই কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো৷ তাও আমার ভাবনার নড়চড় হলো না৷ উনি বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছেন কথাটার মানে৷ কথার জবাব দিলেন না৷ আমার মতো নীরবতা পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ হঠাৎ করেই আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কোলে উঠিয়ে নিলেন৷ আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না৷ সব কিছুর জন্য আমার চলে আসাটা দায়ী মনে হচ্ছে৷ না আমি আসতাম না আব্বুকে হারাতাম৷ সব কিছু নিছক একটা ভাবনা? না বাস্তবতা জানি না৷ তবে আমার মনে হচ্ছে এইটাই৷
___________
বার্লিনের একেকটা দিন হঠাৎ করেই আমার কাছে বিষাদময় হওয়া শুরু করলো৷ কবিতা আপুর ডেলিভারি সময় হয়ে গেছে তাই তারা আবার ফিরে গেছেন৷ যাওয়ার আগে শুধু আমার হাত ধরে কাতর কন্ঠে বলেছিলো,
–‘ সব কিছু নিজের মতো হয় নারে নীতু৷ করে নিতে হয়৷ আল্লাহ চেয়েছিলেন বলেই আমার ভাই তোর জীবনে এসেছে৷ আমার ভাই তোকে আগলে রাখবে৷ মামুর কষ্টের জায়গা কেও পূরণ করতে পারবে না কিন্তু মেয়েদের বিয়ের পর সেই জায়গা টা তার স্বামীর হয়ে যায়৷ তুই ভালো থাকবি৷ আর তোকে ভালো রাখবে আমার ভাই৷ ‘
আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলাম৷ আপু চলে যাওয়ার পর সব আরো অসহনীয় হয়ে উঠলো৷ জিনিয়াটাও ফোন দিয়েই কান্না করে৷ আব্বুর রাজকন্যা৷ হঠাৎ করেই সব শেষ৷ ফুঁপির কাছে আছে কিন্তু ভালো নেই৷ মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কান্না করে বলে,
–‘ আপু,আমাকেও মেরে ফেল৷ নয়তো আমি নিজেই মরে যাবো৷ আম্মু নেই,তুই নেই এমনকি আব্বুও নেই৷ আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে রে৷ ‘
আমি উত্তরে কাঁদি৷ ফুঁপি আদর মাখা হাতে ওকে আগলে রাখে৷ তারা আছে বলেই আমি ভরসা পাই৷
__________
ক্লাসে উদাস হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কিছু খুজে কাজ খুজে পাচ্ছি না৷ থেকে থেকে আব্বুর কথা আর দেশের কথা মনে পড়ে৷ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস চলছে এর মাঝে একজন এসেই আমার খোজ করলো৷ আমি চমকে উঠলাম৷ পুরো ক্লাস আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ স্যার আবার প্রজেক্টরের দিকে মনোযোগ দিতেই আমি ব্যাগ হাতে আলুথালু পায়ে তার সাথে বেরিয়ে এলাম৷ হঠাৎ কে এলো আমার খোজ করতে? বাইরে বেড়িয়ে কাওকে খুজে না পেয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ হঠাৎ পেছন থেকে হাতে টান অনুভব হতেই স্বস্থির নিশ্বাস ফেলি৷ তার হাতের ছোঁয়া বড্ড চেনা৷ আমি সামনে ঘুরে থেকেই উদাস ভাবে বললাম,
–‘ আপনি এখানে? ‘
উনি আমাকে সামনে ঘুরালেন৷ ছুটে চলা চুল গুলো কানের পিঠে গুজে দিলেন৷ আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম৷ উনার ঠোঁটে হাসি নেই৷ গায়ে ধূসর বর্ণের শার্টটার বোতাম গুলো বুকের উপর দুইটা খোলা৷ বরফ ঠান্ডা দিনে এইভাবে রয়েছেন ভেবেই অস্থির ভাবে বললাম,
–‘ ঠান্ডা লাগে না আপনার? ‘
–‘ চোখে পড়লো তোর? ‘
তার নির্মল কথার রেশে কেঁপে উঠলাম৷ তার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য আগাতেই আমার হাত আঁকড়ে ধরেন উনি৷ আমার হাত তার বুকের উপর শক্ত করে ধরে বললেন,
–‘ কবে পাবো আমার সেই ভীতু চোখের চঞ্চল নীতুকে৷ যে লজ্জায় সিটিয়ে থাকবে৷ আর লজ্জায় রাঙা হয়ে আমার বুকেই মুখ লুকাবে৷ ‘
আমি নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম৷ চুল গুলো বেখেয়ালি ভাবে উড়ে চলেছে৷ আমি জোর করেই তার খুলে রাখা বোতাম গুলো আটকানোর জন্য একদম কাছে গেলাম৷ তার শরীর থেকে উন্মাদনার সুবাস বইছে৷ হঠাৎ কেমন জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা তীব্র হলো৷ আমি নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেয়েও পারছি না যে৷ আটকে দিয়েই দূরে সরে আসতে গেলে উনি আমার হাত দুটো আগের ন্যায় ধরে রাখেন বুকের বা পাশে৷
আমি মাথা নীচু করে বললাম,
–‘ কাজ শেষ? ‘
–‘ আর কিছু বলার নেই?’
উনার কন্ঠে অভিযোগ৷ আমি তার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বললাম,
–‘ আমার সময় চাই৷ বুঝেন তো আপনি? ‘
উনি আমার হাত ধরেই গাড়ির সামনে এনে বসতে বলে বললেন,
–‘ রৌদ্দুরের প্রেমের বৃষ্টি হঠাৎ হচ্ছে না৷ কেন হচ্ছে না? তারা কেন নামছে না আকাশ ভেদ করে? তাদের কি ছুটে চলার প্রয়াস নেই? ‘
— ‘ রৌদ্দুরের আকাশে যে মেঘ ঢাকা পড়েছে৷ কান্নার বৃষ্টি গুলো নামছে৷ ‘ কথাটা বলতে চেয়েও পারলাম না৷ কিছু কথা এখন উহ্য রাখতে ইচ্ছা হয়৷
কোনো এক সুপ্ত সকালে মিষ্টি রোদের সকালে ঘুমের রেশ যখন গভীর তখন পেছনে থেকে কারো বলিষ্ঠ হাত জোড়া কোমর আঁকড়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়৷ উষ্ণতার আলিঙ্গন ভেদ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে, ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটাও মোহনীয় লাগে৷ জীবন বহমান৷ সময়ের স্রোতে প্রিয়জনের মায়া ত্যাগ করেই বাঁচতে হয়৷ কখনো ডুকরে কেঁদে উঠেও অকারণেই হাসতে হয়৷ ওইযে, ‘ জীবন যে থমকে থাকে না৷ ‘
এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে এগিয়ে যায়৷ সাথে বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস গুলোও হাওয়ার তালে তালে মিলিয়ে যায়৷ কখনো উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হয়ে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েও একরাশ কান্না দিয়ে যায়৷ একজনের জায়গার শূন্যতা পূরণের জন্য আরেকজন ঠিক এসে যায়৷ হয়তো শূন্যতা পূরণ হয় না, তবে বাঁচার,বেঁচে থাকার আগ্রহ তৈরি হয়৷ আব্বুকে হারানোর তিন মাস কেটে গেছে৷ এই তিনটা মাস, একটা মানুষ আমাকে সামলিয়েছে সে নিজেই জানেন৷ রুড বিহেভ আমি করেছি কিন্তু সে হাসি মুখে আমাকে সামলিয়েছে৷ তার করা দুষ্টুমি গুলো হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে৷ মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নিতে নিতে অন্ধকার ময় তিনটা মাস কেটে গেছে৷ আব্বু নামক ছায়া হয়তো নেই কিন্তু,আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার একজন মানুষ আছেন৷ আমার ঘুমের রেশ কেটে গেছে৷ আলতো চোখে উনার দিকে তাকালাম,তিন মাসে তাকিয়ে দেখা পর্যন্ত হয় নি৷ মুখের আদল পালটিয়ে কেমন দায়িত্বশীল পুরুষের ছাপ পড়েছে৷ ক্লান্তি আর চিন্তায় মুখের রঙ কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে৷ হঠাৎ করেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো৷ কতদিন নিজের যত্ন নেয় না সেই জানে৷ আমি নিজের শোকে কাতর হয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি৷ আমি নিজের হাত দুটো তার গালের মাঝে রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলাম৷ ঘুমের মাঝে উনি ভয় পেয়ে উঠে বসতে গেলেন আমি দিলাম না৷ উনি ভয় পাওয়া শীতল সুরে বললেন,
–‘ কি হয়েছে৷ মামুকে সপ্নে দেখেছিস? ‘
–‘ না৷ ‘
–‘ তাহলে? মনে পড়েছে মামুর কথা? এমন করে কাঁদে না বউ৷ আমি আছি তো৷ ‘
উনার আদুরে কথায় কান্নার বেগ আরো বৃদ্ধি পেলো৷ আমি শক্ত করে উনার জড়িয়ে ধরলাম৷ উনি একহাতে জড়িয়ে রেখে আরেক হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ আমি ফুঁপিয়ে বললাম,
–‘ আমার জন্য আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই না? ‘
–‘ কেন কষ্ট হবে বাবু? তুই তো আমার৷ তোর কষ্টের কারণ তো আমি৷ অপরাধী আমি৷ তোকে না নিয়ে আসলে হয়তো শেষ দেখা টা দেখতে পারতি৷ ‘
উনি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন৷ আমি উনার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অপরাধ বোধ কন্ঠে বললাম,
–‘ নতুন করে বাঁচতে চাওয়া অপরাধ নয়৷ ‘
–‘ হ্যাঁ, কিন্তু প্রয়োজনের জন্য স্বার্থপর হওয়া টা বিরাট অপরাধ৷ তোর চুপ থাকা তার বড় প্রমাণ৷ লাস্ট কয়েকটা দিন আমার সাথে থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখাটা কি অনেক দরকার ছিলো? আমি যে মরমে মরে যাচ্ছি তোর দহনে৷ ‘
আমি উনার বুকে মাথা রেখেই অনবরত কেঁদে চলেছি৷ উনি আমার মাথা উঠিকে গাঢ় চুমু খেলেন৷ আমি কেঁপে উঠলাম৷ উনার শার্ট খাঁমচে ধরে অবিরাম কেঁদে চলার মাঝেও আজ তৃপ্তি পাচ্ছি৷ অনেক টা দিন ঠিক হওয়ার জন্য নিলেও মনের কোণে যে তার নামক ভালোবাসার খাতা পূর্ণ৷ রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টির নব্য সূচনা৷
____________________
বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে৷ অস্থির পায়ে আমি বাইরে দিকে এগিয়ে আবার ফিরে ফিরে আসছি৷ অন্ধকার ময় ঘরের মাঝে হঠাৎ করেই তার সেই রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টির ডায়েরি টা বের করে বুকে আঁকড়ে ধরলাম৷ এতেও তার ছোয়া আছে৷ ডায়েরির পাতায় তার আর আমার ছোট ছোট অনুভূতি গুলো সাজাচ্ছি৷ আজ আরেকটা পাতায় লিখবো তার আর আমার কাহিনি৷ প্রেমের কাহিনি৷ শত বাধার পরেও যে,ভালোবাসার অংশ থাকে সেই কাহিনি৷ বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেতেই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম৷ কফি কালারের শার্ট পড়ে ভিজে চুপসে আছেন উনি৷ হাত দিয়ে পানি ঝারতে ঝারতে এগিয়ে আসছেন৷ আমি শাড়ির কুঁচি ধরে লাফিয়ে উনার সামনে গেলাম৷ উনি অমায়িক হাসলেন৷ শাড়ির ফাঁকে বেরিয়ে থাকা কোমর ধরে কাছে নিলেন তার৷ আমি লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
–‘ ভিজে যাচ্ছি তো৷ ‘
–‘ ভেজার জন্যই তো এসেছো৷ ‘
তুমি৷ আবার সেই তুমি ডাকে চুপসে গেলাম৷ আমি মুখ লুকালাম তার বুকের মাঝে৷ উনি চুল গুলো খুলে দিলেন টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ উনি আমার গালে চুমু খেয়ে বললেন,
–‘ রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টির পাতা কিন্তু শেষ হয়েও হয় নি৷ ‘
আমি মুখ তুলে তাকালাম৷ উনি আমার ঠোঁট ছুয়ে বললেন,
–‘ সেই প্রেমের বৃষ্টিতে আরো কাহিনী থাকবে৷ ‘
আমি আজও তার শার্টের বোতাম আটকে দিলাম৷ বৃষ্টির মাঝে একফালি রোদ উঁকি দিতেই চমকে উঠলাম দুজনেই৷ উনি ঝট করে কোলে উঠিয়ে পা বাড়ালেন৷ আমি আজও ভয় পেয়ে তার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে আছি৷ গাঢ় চুমু খেলেন আমার ঠোঁট জোড়তে৷ বৃষ্টির পানি ছুয়ে যাচ্ছে সব৷ প্রগাঢ় হাওয়া বইছে সাথে সোনালি রোদ৷ আকৃষ্টতা হয়ে উঠলো কিছু মূহুর্ত৷ সাথে সাক্ষী রৌদ্দুরে বৃষ্টি৷ আমাদের প্রেমের বৃষ্টি৷ রৌদ্দুরে প্রেমের বৃষ্টি৷
সমাপ্ত