লম্বা স্বপ্ন দেখলাম। তবে স্বপ্ন হলেও অনেকটা মিল পাচ্ছি নিজের সাথে। অনেক বছর আগে, যখন স্কুলে ছিলাম তখন একটা মেয়ের সাথে কথা হয়েছিল। এভাবেই।
আচমকা কল এসেছিল। নাম ছিল খুব সম্ভবত নাজাত। আমাদের ক্লাসেই পড়তো। তবে ভিন্ন স্কুলে। অনেক সময় ধরে কথা হয়েছিল ওর সাথে। অনেকটা কাকতালীয় ভাবে। কিছু সময় কথা বলার পর আর থামেনি। সে মেয়েটা নাকি আমার কথার মায়ায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু, এই মেয়েটা নাজাত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, সে তখন থেকেই একজনকে গভীরভাবে ভালোবাসে। আমার এক বন্ধুর সাথে তার খুব ভালো প্রেমবন্ধন ছিলা অবশ্য এখন তাদের অবস্থা সম্মন্ধে আমি জানি না। অনেক বছর হয়ে গেল কথা হয় না। অবশ্য বন্ধুটার সাথে খানেকটা যোগাযোগ হয়।
ওর নাম নিলয়। নিলয় অবশ্য জানত না যে নাজাতের সাথে আমার কথা হতো। জানলেও অবশ্য তেমন কোনো সমস্যা হতোনা। কারণ হুট করেই কথা বলা শুরু হয়েছিল এবং হুট করেই শেষ। অনেকটা কাকতালীয় ব্যাপার।
বিষয়টা আমাকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। পড়ালেখা প্রায় শেষের দিকে। এই সময়ে এসেও ভূতে বিশ্বাস করাটা সত্যিই মানানসই নয়। তবু কেমন যেন লাগছে।
হঠাৎ ফোন আসল। আননোন নাম্বার। মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেলো। আচমকা ঘামতে থাকলাম। হয়তোবা ভয়ে! ভয়ে ভয়ে ফোন হাতে নিয়। কল রিসিভ করি। ও পাশ থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসল,
“হুজুর!”
আমি ভাবলাম হয়ত রং নাম্বার। আমি না বুঝার মতো করে বললাম,
“হ্যালো!”
” ওই ব্যাটা, আমি নিলয় বলতেছি।”
“ওহ! নিলয়। কেমন আছিস বল।”
এখন নিশ্চিত হলাম কেন আমাকে হুজুর ডাকল। ছেলে মুটামুটি ভালো না হলেও দাড়ি রাখায় স্কুলের সবাই হুজুর বলে ডাকত।
“এইতে চলছে।”
“কোথায় এখন?”
“তোর আশেপাশেই আছি।”
“বাসায় কখন আসলি?”
“দুইদিন হলো। কেন?”
“আজ রাতে বাসায় আয় তাহলে। সবাই আসবে।”
“কেন? প্রোগ্রাম আছে?”
“কী?”
“কাল আমার বিয়ে।”
“তলে তলে এত কিছু? তো বিয়েটা কার সাথে?”
“তুই চিনবি না। আমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে।”
“নাজাতের সাথে না তোর লুটুর পুটুর চলতো? এখন আর নায়?”
“তুই আজকে আয় আগে। পরে বলছি সবটা।”
“ওকে বস! তুই লোকেশনটা দে।”
“আচ্ছা। আমি টেক্সট করে দিব। রাখি এখন।”
“ওকে বাই।”
কল কেটে দিলাম। অনেক বছর পর পুরনো বন্ধুর সাথে কথা বলে মনটা ভালো হয়ে গেলো। মেয়েটার কথা মাথা থেকে বাদ দিয়ে আবার শুয়ে পরলাম। মাকে আমিই বলেছিলাম না উঠলে যেন পানি মারে। এখন সেই আমিই আবার শোয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়লাম আবার। এক ঘুমে সারাদিন কাভার।
চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসল। তখনই ঘুম ভাঙে। তাও মোবাইলের রিংটোনে। এবার স্ক্রিনে আসে অদ্ভুত টাইপের নাম্বার।
ঘুম জড়ানো চোখে কল রিসিভ করাই নাম্বার খেয়াল করিনি। ফোন কানে দিয়ে বললাম,
“হ্যালো!”
“এতক্ষণ ঘুমানো লাগে?” -মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসলো।
“আমি যে ঘুমে ছিলাম তা আপনি জানলেন কিভাবে?”
“পেত্নীরা সবই জানে।”
আচমকা এই কথা শুনে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। নাম্বার আছে ঠিকই স্বপ্নের মতো। ডিজিটগুলো ভিন্ন হলেও প্যাটার্ন একই।
“তাহলে তুমি সত্যিই….! ওটা না স্বপ্ন ছিল?”
“হুম। স্বপ্নই ছিল। তবে তা আমি দেখিয়েছি। আজ কিন্তু আমার সাথে দেখা করার কথা। গভীর রাতে।”
“আমার কাজ আছে। তাই পারব না।”
নিলয় যেহেতু ভিন্ন ধর্মের, তাই ওদের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান থাকতে পারে। তাই সময় লাগবে বলে পারব না বলে দিলাম।
“ওর ওখানে বেশিক্ষণ থাকার প্রয়োজন পরবেনা। এর আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। আমি রাতে আবার কল দিব। স্থান আর সময় বলার জন্য। তোমার অপেক্ষায় থাকব।”
“শেষ হয়ে যাবে মানে…..?”
কল কেটে গেল। মনে মনে আবার ভয় কাজ করতে শুরু করেছে। অপেক্ষার পালা এবার।
কী হয়………….!
নিলয়ের বাসায় যাবার জন্য রেডি হলাম। নিলয় টেক্সট করে ঠিকানা দিয়েছে। তবে বাসার নয়। একটি কমিনিউটি সেন্টারের। লোকেশন অনুসারে রওয়ানা দিলাম। ওখানে পৌঁছেই মনের সব ভয়-টয় উধাও হয়ে গেল। স্কুলের প্রায় অনেকেই আছে। সবার সাথে গল্পে মেতে উঠলাম।
নিলয়কে একলা পাওয়ায় ওকে নাজাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন প্রায় রাত এগারটা বাজে। ও বলল,
“না, রে। এখন আর এ সম্পর্ক নায়। মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গেছে। বুঝলি বন্ধু, ভালোবাসা এমনই ৷ ছলনাময়! ওয়েট, আমি আসছি।”
মোবাইলে কল আসায় নিলয় চলে গেল। কমিনিউটি সেন্টারটি অনেক বড় এরিয়া জুড়ে। সামনে বিরাট উঠোন। পিছনদিকে বাগানও আছে। পরিকল্পিত বাগান। এর পাশে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা। নিলয় চলে যাওয়ার বাকি বন্ধুদের দিকে চলে আসলাম আমি।
আধঘন্টা হয়ে গেলো নিলয় বেরিয়েছে। এখনো ফিরেনি। ১১ টা ৩৫ মিনিটে আমার মোবাইলে কল আসে। মেয়েটার কল। বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করলাম।
“হ্যালো!”
“হুম। তোমার মনে হয় একটু পরই চলে আসা লাগবে।”
“কেন? আমি সকাল উব্দি বন্ধুদের সাথে থাকব।”
“তোমার বন্ধু থাকলে তবেই তো তুমি ওদের সাথে থাকবা!”
“মানে?”
“মানে, সকাল উব্দি নিলয় থাকবে না।”
“কী যা তা বলছ ? তুমি কোথায়? গান বাজনার আওয়াজ আসছে কেন?”
“আমি এখন খুব সুখী। বড্ড ভালো লাগছে আজকে।”
“কেন?”
“আচ্ছা রক্তের সাধ কেমন?”
“মানে ?”
“ওহ! তুমি তো বুঝবেনা। আহ! রক্তের মজা, সত্যিই বলে বুঝাতে পারব না তোমাকে।”
“পাগল হয়ে গেছো তুমি,এ্যা?কীসব আজেবাজে কথা বলছ?”
কল কেটে দিতে চাইলাম। কিন্তু না। কাটা যাচ্ছে না।। ওর ইচ্ছা ছাড়া কথা বলা শেষ করতে পারবনা এটা আমি বুঝে গেছি। তাই, কথা বলা চালিয়ে গেলাম। ওপাশ থেকে ও হাসছে। ভয়ংকর হাসি। হাসিটা মনে হচ্ছে মোবাইল থেকে নয়, একদম কানের গোড়ায় এসে হাসছে।
“আসলে হয়েছে টা কী বলতো?”
“নিলয় আর নেয়।”
“মানে? এখন না ওর সাথে কথা হলো আমার! এইটো আধঘণ্টা আগেই।”
“হুম। বলেছিলে ঠিকই, কিন্তু এরপর থেকে আর বলার সুযোগ পাবে না।”
“কেন?”
“কারণ নিলয়ের কলিজাটা এখন আমার হাতে। আর, হৃদপিণ্ড রক্তশূন্য প্রায়। হা-হা-হা।”
“কী?”
গলা শুকিয়ে গেল আমার।
“শুনো। আজ রাত ১টা ৪৫ মিনিটে যে বিল্ডিংটা বলেছিলাম তার নিচে চলে আসবে। আমি ছয় তলার বেলকোনীতে থাকব। ততক্ষণে রক্তের সাধটা সম্পূর্ণ নিয়ে নিই আমি। বিষণ তৃপ্তী লাগছে আজ। হা, হা হা।”
“তুমি কোথায় এখন? আর কি সব বলছ এগুলো?”
“বিশ্বাস হচ্ছে না? বিল্ডিং থেকে বের হয়ে পেছনের বাগানে দিকে এসো। সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
কল কেটে গেল। আমি হতবম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি। একটা বন্ধু এসে খোঁচা দিয়ে বলে,
“কী হয়েছের তোর? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো এভাবে?”
” আমার এক্ষুণি একটু বেরোতে হবে। আয় না। তুইও যায়। এখনই চলে আসব।”
“চল। নিলয়ও তো আসছে না। ততক্ষণে নাহয় তোকে নিয়ে ঘুরে আসি।”
সে রাজি হওয়ায় পার্কিংলটের দিকে এগোলাম দুজনে। পার্কিংলট শেষ দিকে। এর পাশেই বাগানটা। গাড়ি বের করে যেই উঠবো, তখনই একটি গাছ নড়ে উঠলো। আমি সুযোগ পেয়ে বাগানের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এতক্ষণ উব্দি এই সুযোগটাই খোঁজছিলাম।
পেছন পেছন বন্ধটাও আসছে। কিছুক্ষণ চারপাশে ঘাটাঘাটি করলাম। কিন্তু, কিছুই পেলাম না। মেয়েটার উপর রাগ হচ্ছে। কারণ, হুদায় ওর জন্য বের হওয়ার নাম করতে হয়েছে। এখন বেরিয়ে যাবো টা কোথায়। বন্ধুটা বলল,
“চল। এখানে কিছুই নেয়। এমনিতে হয়ত নড়ে উঠেছে।”
“চল। যাওয়া যাক।”
বলেই রওয়ানা দেওয়া শুরু করলাম। এমন সময় হাতে কী যেন অনুভব করলাম। তরল জাতীয় । হাত তুলে আলোতে নিয়ে দেখলাম। রক্ত! উপর দিকে তাকালাম।
যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। গাছের ডালে ঝুলে আছে নিলয়ের দেহ। দেখে মনে হচ্ছে যেন গাছের ডালে আরামছে ঘুমাচ্ছে ও। বন্ধুকে ডাকলাম। ও দেখে হতবম্ব। চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করলো। আমার তেমন কোনো এক্সপ্রেশন নেয়। কারণ আমিতো জানিই। কে করেছে কাজটা। কাউকে বলাও হবে বোকামি। কারণ, পেত্নীোর কথা কথা বললে সবাই হাসবে। উল্টা আমার উপর একটা সন্দেহ চলে আসতে পারে। যদিও আমি এতক্ষণ উব্দি বন্ধুদের সাথেই ছিলাম।
সবাই কাঁদছে। আমি ওর দেহটার কাছে গিয়ে মেয়েটার কথার শুদ্ধি পরিক্ষা করার চেষ্টা করলাম। পেটের দিকে আর বুকের দিকে হাত বোলালাম। হালকা চাপ দিয়ে দেখলাম।সাধারণত মানুষ মারা গেলে
ঠান্ডায় জমে শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু, এর শরীরটা কেমন যেন ব্যতিক্রম লাগছে। হালকা চাপা দেওয়ার সময় মনে হলো ভেতরটা ফাঁকা। সবকিছু কেমন যেন অদ্ভূত লাগছে।
কিছু সময় ওখানে থেকে ১ টার দিকে বের হয়ে আসলাম। মনটা কেমন যেন হয়ে গেছে। বেচেরি! কাল বিয়ে। আর আজকেই সে মারা গেল। দুনিয়াটা বড্ড অদ্ভত। কার ভাগ্যে কী তা বলা মুশকিল।
মেয়েটা আবার কল করেছে। প্রতিবারের মতোই ডিজিট ছাড়া নাম্বার। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। তাই পকেটে গুঁজে রাখলাম। ফোন সাইলেন্ট করা সত্ত্বেও বাজছে। অস্বাভাবিক কিছু না।
ফুতফাত ধরে হাঁটছি। বন্ধুরা বাসায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। আমি ইচ্ছা করেই নেমে গেছি। হাঁটতে আমার প্রচন্ড ভালো লাগে। তার উপর আজকের হাঁটাতে একটা বিশেষত্ব আছে। মনকে প্রশান্তি দেওয়ার লক্ষ্য।
কলটা অটোমেটিক রিসিভ হয়ে গেলো। এখন রিংটোনের বদলে মেয়েটার আওয়ার শুনা যাচ্ছে। কল ভলিয়াম একদম কম থাকা সত্ত্বেও আওয়াজটা লাওড স্পিকারের মতো মনে হচ্ছে। ওর হাত থেকে সহজে বাঁচা যাবে না। তাই ফোনটা কানে নিলাম।
বিরক্ত লাগছে। যে ছেলে প্রত্যেকটা বিষয়কে মজা করে নিতাম, সেই ছেলে এখন হাসতেই ভূলে গেছি। এই প্রথম কোনো ছেলে বা মেয়ের উপর বিরক্ত হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। কারণ ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, আমার সাথে কথা বললে আমি নির্দ্বিধায় বলে গেছি। কিন্তু, আজ কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছি।
“এই চিটার! আমার সাথে না দেখা করার কথা? বাসায় চলে যাচ্ছো কেন?”
“ও হ্যা। আমার মনেই ছিলনা। কিন্তু, এখনতো অনেক দুরে চলে এসেছি। রাস্তায় গাড়িও নেয়। কিভাবে আসবো?”
“চোখটা বন্ধ করো।”
“কেন?”
“আ হা! করো না আগে।”
আমি চোখটা বন্ধ করলাম। একটু পর ও বলল,
“এবার চোখটা খুলো।”
আমি চোখ খোলামাত্র নিজের অস্থিস্তকেও যেন বিশ্বাস হয়নি। বড়সড় একটা শক খেয়েছিলাম। মেয়েটার কথায় ধ্যান ফিরে এলো,
“এখনতো তুমি আমার পাশেই চলে এসেছ। এবার সোজা উত্তর পাশের রোড দিয়ে বিল্ডিংটার নিচে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”
“ওকে।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আমার যে কিছুই করার নায়। এই মেয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সত্যিই সম্ভব নয়।
রাত প্রায় দেড়টা বাজছে। প্রধানসড়ক থেকে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দুইপাশেই বিল্ডিং। বেশিরভাগই পুরনো আমলের। রাস্তার দুপাশে ছোট বড় গাছ আছে। কিছুটা দূরে দূরে রয়েছে স্টিক লাইটের আলো। এখানকার বাতিগুলো লাল। তাই কেমন যেন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে। লাগারই কথা। আমি যে পেত্নীর জালে বন্দি!
ছয় তলা বিল্ডিং এর নিচে আসলাম। কেউ নেয়। উপরে ছয় তলায় কিভাবে উঠবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। মেয়েটাকে যে কল করব সেই সুযোগও নেয়। কারণ, প্রতিবারই কল এসেছে ডিজিটবিহীন নাম্বার থেকে। তাই কেবল আশপাশ হাটাহাটি করছি। হঠাৎ, কল আসল।
“হ্যালো, আমি বিল্ডিংটার নিচে আছি। উপরে কিভাবে যাবো।”
“চোখ বন্ধ করো।”
কল কেটে দিলো। এরপরে কী ঘটবে তা আমি জানতামই। একবার চোখ বন্ধ করায় যেহেতু ৩-৪ কিলো পথ একবারে পাড়ি দিতে পেরেছি। সেই ক্ষেত্রে এই ছয় তলা কোনো ব্যাপারই না। চোখ বন্ধ করতে তেমন একটা দ্বিধা বোধ হলোনা।
চোখ বন্ধ করার পর মনে হলো চারপাশ কেমন যেন ঘাঢ় অন্ধকার হয়ে গেলো। প্রচন্ডভাবে। ভয় লাগলো প্রচুর। হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেললাম।সায়ুবিক তাড়নায়!
কারেন্ট চলে গেছে। চারপাশ ঘুটঘুটে আঁধার। হঠাৎ কেঁপে উঠলো শরীরটা। আশ্চর্য এক অনুভূতি! মনে হলো আমাকে উপর দিকে তোলা হচ্ছে। ভয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, মুখ থেকে আওয়াজ বের হলেই না চিৎকার দিব! হাজার চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলামনা। হাতা পা নাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু নড়ছে না।
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে মেয়েটা হয়ত বা নাজাত। কথা বলাটা তার সাথে মিলে যাচ্ছে। আর তাছাড়া, আজ বিয়ের দিনে নিলয় মারা গেল। তাও, যেভাবে মেয়েটা বলেছে ঠিক সেইভাবে।
কিছুই করার নায়। এখন না পারব পালাতে! না, ওর সাথে দেখা না করে থাকতে পারব। তাই, সামনে কী ঘটে তার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
ভয়টা ক্রমশ বাড়ছে। ছয় তলার বেলকোনি বরাবর উঠে থেমে গেলাম। পায়ের নিচে কিছুই নেয়। কিন্তু, দিব্বি সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছি। বেলকোনিতে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওল্টো দিকে মুখ করা। হালকা বাতাসে ওর চুল উড়ছে। সাদা ফ্রক পড়া। বড্ড সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। এমন একটা ভয়ের মূহুর্তেও এই মেয়েকে দেখে বড্ড ভালো লাগছে।
মেয়েটা আমার দিকে ফিরল। সেই মেয়েটিই! যে আমার স্বপ্নে এসেছিল। তবে, এবারে চোখে চশমা আছে। গোল কাচের কালো ফ্রেমের চশমায় বড্ড সুন্দর লাগছে তাকে। মুখের উপর চাঁদের আলো পড়ছে। চুল এখনো উড়ছে। কাজল কালো চুলগুলো যেন দোল খেতে খেতে মায়া ছড়াচ্ছে। চোখের তারার চারপাশে যেন হিমালয় পর্বত। কালো মণিটা মনে হচ্ছে যেন হিমালয়ের ধবধবে সাধা বরফের উপর অমাবস্যায় ঘেরা এক জগৎ। ঠোঁটের কোনায় মুসকি হাসি। এ হাসি যেন বৃদ্ধকেও তার মায়ায় ফেলবে! মুখের সম্পূর্ণ অবয়বটা যেন পুতুলের মতো!
এমন একটা মেয়েকে দেখলে, আমি তার প্রেমে না পড়ে থাকতে পারতাম না। কিন্তু, সে তো পেত্নী। তার মোহে পড়া নিতান্তই বোকামি!
মেয়েটি আমার দিকে এক নজরে চেয়ে আছে। যেন কোনো হরিণীর নজর। বড্ড মায়াবী সে চাহনী। কিছু সময় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর সে বলে,
“জেদ পূর্ণ হলো?”
“হুম। তুমি এতো সুন্দর!” “আগে ছিলাম না। তোমার দর্শন পেয়েই আমার এই অর্জন।”
“তুমি কে?”
“আমি? তুমি খুব ভালো করেই চিনো আমাকে।”
“না। আমার মনে পড়ছেনা। এমনকি তোমাকে তো আমি কখনো দেখিইনি।”
“তবে, কথা বলেছো। অনেক অনেক সময় ধরে।”
“আমি সত্যিই মনে করতে পারছিনা। প্লিজ বলো, তুমি কে?”
“আমি নাজাত। যার ফোন থেকে কাকতালীয়ভাবে তোমার মোবাইলে কল গিয়েছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে। মনে পড়ে, সেই নাজাতের কথা? যে তোমাকে ‘বড় শয়তান’ বলে ডাকতো।”
“হ্যা। মনে পড়েছে। তুমি না নিলয়ের গালফ্রেন্ড ছিলে?”
“হ্যা। ছিলাম একসময়। এখনতো নেয়। আমিও নেয়। আর, নিলয়ও নেয়। সব শেষ! সব শেষ! হা, হা, হা!”
মেয়েটি হাসছে। তবে তার চোখ অশ্রুজলে টলমল করছে। মনি-মুক্তা ঝড়া হাসি ধীরে ধীরে কান্নায় রুপান্তর হয়। ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে ও। আমি বললাম,
“নিলয়কে মারলে কেন? ও তো তোমাকে অনেক ভালোবাসত। তাইনা?”
“হ্যাহ! ভালোবাসা! পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছুই নায়। সব শুধু ছলনা।”
“মানে? খুলে বলো।”
“আমাদের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। নিলয় বিষণ ভালোবাসত আমাকে। এবং আমিও। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা সমাজ মেনে নেয়নি। কারণ, নিলয় ছিল ভিন্ন ধর্মের। দুইজন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মালম্বী হয়েও, অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমনিতে বন্ধুর মতো পরিচয় ছিলো আমাদের। কথা হতো। ধীরে ধীরে মায়া জন্মে যায়। হঠাৎ একদিন, নিলয় এসে আমাকে ভালোবাসার কথা বলে। আমারও মায়া জন্মে যায় তার প্রতি। তাই, না করতে পারিনি। সবটা কেমন যেন অদ্ভুতভাবেই হয়ে যায়। কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। অনেক দিন ধরে চলছিল সম্পর্কটা। মধ্যে আমাদের জীবনে ঘটে যায় অনেক করুণ কাহিনী। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে আমাদের এই পরিণতি হবে। একটা সময়, বাবা আমার প্রতি কেমন যেন হয়ে যান। অনেকটা অবহেলা করতেন বলে মনে হতো আমার। কারণটা সত্যিই জানতাম না আমি। একদিন হঠাৎ আমাকে ডেকে বলেন তার পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আমার সম্মতি নেওয়ার দরকারও মনে করেননি। পরে জানতে পরেছি একটা ছেলে বাবাকে সবটা বলে দিয়েছিলো। আমার আর নিলয়ের ব্যাপারে। শুধু তাই নয়। ওর যা ইচ্ছে তাই বলেছে।বানিয়ে বানিয়ে মিত্যাকে সত্য করে নানান কথা বাবার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। ছেলেটাকে আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন ও আমাকে খুবই ডিস্টার্ব করতো। কিন্তু, ছেলেটার বাজে অভ্যাস ছিলো। আর, সে বাবাকে যা ইচ্ছা তাই বলে, বাবাকে নিজের আয়ত্বে এনে আমাকে বিয়ে করার বন্দোবস্ত করে।সবটা তার প্লেন মতোই হয়েছে। কিন্তু, আমি বাবার মুখের উপর কিছুই বলার সাহস পাইনি। কেবল নিজের রুমে গিয়ে অজোরে কেঁদেছি।”
মেয়েটি চোখের পানি মুছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বলতে গেলে শুন্যে ভাসছি। নাজাত আবার বলা শুরু করে,
“নিলয়কে বলার পরও তেমন কোনো সমাধান পেলাম না। ওর তো তেমন কিছু করারও ছিল না। কারণ, দুজনেই পড়ালেখার মধ্যখানে। তাছাড়া, এমন সুযোগও ছিলনা যে, ও বাবার কাছে এসে আমাদের ভালোবাসার কথা বলবে। কারণ, ও ভিন্ন ধর্মের। না আমার বাবা-মা তা মানবে, না বাইরের সমাজ। আমার বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসে। বিয়ের আগের দিন নিলয়ের সাথে দেখা করি। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেবল কেঁদেছি। কিন্তু, কোনো সমাধান পায়নি। আমাদের এত বছরের প্রেম, নিমিষেই ভেঙ্গে যাবার পথে। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হয় পালিয়ে যাওয়ার। নিলয় অনেক বুঝালো। কিন্তু, আমি নাছোড়বান্দা। শেষে প্রেমের জয় হয়। তবে, ক্ষণিকের জন্য। দুজন বিয়ের রাতে পালিয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিই বিয়ে করার। কিন্তু, বিয়ে কোন পদ্ধতিতে হবে? নিলয় বৌদ্ধ, আর আমি মুসলিম। এ নিয়ে ছোটখাটো একটা দন্দের সৃষ্টি হয়। কেউ কি আর নিজ ধর্মের পদ্ধতি ত্যাগ করতে চায়? শেষে একজন খ্রিস্টান মিশনারি সুযোগ নিল। দুজনকে ভুলিয়ে বালিয়ে বিয়ে পড়ান খ্রিস্টান রীতি মতে। বিয়ের পর মোটামোটি সুখেই ছিলাম। একদিন হঠাৎ নিলয় তার বাসার কথা বলে উঠে। পরে অবশ্য আর তেমন কোনো ঘটনা হয়নি। কিন্তু, আমাদের এই সূখ বেশিদিন টিকেনি। যে ছেলেটা আমাকে ডিস্টার্ব করত এবং আমার বাবাকে বলে দিয়েছিল। ঐ ছেলেটা নিলয়ের কাছেও আমার নামে যা তা শুনায়। নিলয় ওকে চিনতো না। তাই, তার মনেও আমি একপ্রকার ক্ষতের মতো হয়ে উঠি। আর, আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে দুরুত্ব তৈরি হয়। ঐ ছেলেটার সাথে আমি কি দোষ যে করেছি, সেটাই ভেবে পাই না।”
“তো শেষ পর্যন্ত কী হলো?”
আমি গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছি। মেয়েটার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে সত্যিই আমার চোখে পানি চলে আসছে। হয়ত বড্ড ভালোবাসতো ও নিলয়কে। কিন্তু, এখানে আমি কিভাবে যুক্ত হলাম তা সত্যিই জানি না। হাত দিয়ে চোখ মুছে নাজাত বলে,
“একসময় নিলয়ের আমার প্রতি অনিহা চলে আসে। আসলে, ঐ লম্পটটা এমন ভাবেই ওকে বুঝিয়েছিল যে ওর মধ্যে আপনা আপনিই এমন ভাব চলে আসে। একদিন ও বলে, “তোমার কথা ধরে পালিয়ে আসাটায় জীবনের সবচেয়ে বড় ভূল ছিল। আমি চললাম।” ওর এই কথাটা আমার কাছে বিষের ছুরির মতো মনে হয়েছিল। ও চলে যায়। একটুও পিছুটান কাজ করেনি তার। ও চলে যাবার পর দুনিয়াটা কেমন যেন লেগেছে আমার। যেন সম্পূর্ণ বৃথা। ভালবাসার মানুষের এভাবে ছেড়ে চলে যাওয়াটা সয়তে পারলাম না। শেষে আত্মহত্যা করি। আমি শেষ হলেও আমার অতৃপ্ত আত্মার তৃষ্ণা মিটেনি!”
“তাহলে, এ সবের জন্যতো ঐ মানুষটাই দায়ী হবার কথা। নিলয়কে মারলে কেন?”
“পাপ নিয়ে মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারেনা। তার জন্য এই পাপের সাজা হিসেবে চরম শাস্তি অপেক্ষা করেছিল। আমাদের বিচ্ছেদের কদিন পরেই ও এক্সিডেন্টে মারা যায়। পাপের শাস্তি ও এমন ভাবেই পেয়েছে।”
“তাহলে নিলয়ের ব্যাপারটা?”
“নিলয় আমার ওখান থেকে চলে আসার পর ঠিকই সাধারণভাবে জীবন উপভোগ করছে। কোনো পিছুটান অনুভূত হয়নি একটুও। যে মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসত, সে আজ আমি ছাড়া বড্ড খুশি। আমার মৃত্যুর জন্য সেও এ প্রকার দায়ী।ভালোবাসার অফুরন্ত সম্ভার থাকলেও, আমার প্রতি সে এতটুকুও বিশ্বাস স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। বড্ড হাসি পায়। জানো ও সেই মানুষ, যে আমার কোলে মাথা রেখে বলতো, “তোমার হাজার হাজার দোষ থাকলেও আমি ভালোবাসার টেউয়ে সব দোষকে মুছে দিয়ে সারাজীবন তোমার পাশে থাকবে।” হা, হা হা! এই তার পাশে থাকা?”
নাজাত হাসছে ঠিকই। কিন্তু, তার মধ্যে কান্নার ভাবটা আরো জোড়ালো হচ্ছে। আমি নিরব ভাবে শুধু শুনে যাচ্ছি। কিছুই যে করার নেয় আমার। মেয়েটি চোখের পানি মুছে আবার শুরু করে,
“ঐ ছেলেটা যা ইচ্ছে তা বলেছে ঠিকই। কিন্তু, নিলয়ের কী একবারও উচিত ছিলনা, বিষয়টা যাচাই করে দেখার? হুমম। এটাই নাকি তার ভালোবাসা! হা, হা,হা! আমি না… আমি না সয়তে পারিনি বুঝলে? বড্ড কষ্ট পেয়েছি। কত কেঁদেছি। কিন্তু, না! সে থাকবেই না। চলে গেল। আমাকে ছেড়ে সে মায়ের কাছে যাবে বলে চলে গেলো। আবার এখন নাকি তার বিয়ে। মায়ের পছন্দ মত বিয়ে করছে। ওমন ভালোবাসা এক নিমিষেই ভুলে যাওয়ায় পরিণত হলো তার কাছে। ও আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ভালোবাসবে তা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই শেষ করে দিয়েছি। তার হৃদয়টাকে নিজের করে নিয়েছি। একদম নিজের করে। হা, হা, হা! ভালোবাসা! সবটায় ছলনা। শুধু মিছে মায়া। ভালোবাসার বলতে কিছুই নেই। ভালোবাসা মানেই অপবিত্র!”
“ভালোবাসা অপবিত্র নয়। তোমার ভালোবাসাটা ছিল অপবিত্র। তুমি কি ভালোবাসার প্রকৃত সুখ পেয়েছ। না, পাওনি। কারণ, তোমার ভালোবাসা অবৈধ ছিল। আর সেই কারণের তোমার কাছে ভালোবাসা অপবিত্র মনে হয়। তোমার সামান্য একটা সিদ্ধান্তে কতজন কষ্ট পেয়েছে ভেবে দেখেছো? নিলয়ের বাবা মারা গেছে অনেক আগে। মার সাথে সে একা থাকত। তোমার সিদ্ধান্তে তিনি একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলেন। ওনার কথা বাদ-ই দাও। তোমার বাবা-মা কতখানি কষ্ট পেয়েছে ভেবে দেখেছো? এ্যা? শুধু নিজের কথা ভাবলে হয় না। এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখে থাকতে চাইলে এমনটাই হয়। ওয়েট! আমি একটা বিষয় বুঝছি না। তোমাদের এসবের মধ্যে আমি আসলাম কিভাবে? আমার সাথেতো শুধু কাকতালীয়ভাবে কদিন কথা হয়েছিল। এবং, এর মধ্যকার সবই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এতদিন পর আবার আমার সাথে তোমার এবং তোমাদের এই কাহিনীর সাথে সম্পর্ক কোথায়?”
“আছে। যখন কথা বলতাম, তখন একটা মজার বিষয় ঘটেছিল। মনে আছে, কথা বলা হবে না বলেও ৮-৯ ঘণ্টা কথা বলেছিলাম ফোনে। আসলে আমি তোমার কথার মায়ায় পরে গেছিলাম। কথা বলবনা সিদ্ধান্ত নিলেও কেন জানি পারতাম না। অবশ্য তুমি কোনোদিন নিজ থেকে কথা বলতে চাওনি। তবু……!”
“কিন্তু, আমাদের যোগাযোগ যেভাবে শুরু হয়েছিল ঠিক তেমনি হুট করে শেষও হয়ে গিয়েছিল। এত বছর পর আবার…..!”
“না। আমরা এর পরেও অনেক কথা বলেছি। অনেক।”
“মানে?”
“হ্যা। কদিন ধরে তুমি একটা মেয়ের সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করতেছো। মনে পড়ে?”
“আমি তো অনেকের সাথেই কথা বলি। অবশ্য তার মধ্যে প্রায় সবই ওরা শুরু করেছে। আসলে বলতে গেলে, আমি নিজে থেকে তেমন কারো সাথে কথা বলিনা তা জানো-ই। কিন্তু, কেউ বললে আমি এড়িয়েও যায় না। হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে। তাই এগুলির মধ্যে কোনটা তুমি, তা বলা মুশকিল।”
“ওহ! ঐ যে ওই আইডিটা। যেটার নামে তুমি তোমার একটা গল্পের চরিত্র তৈরি করেছো।”
“মনে পড়েছে।”
নিলয় যখন আমার প্রতি অবহেলা করতে শুরু করে, তখন আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। আমি জানতাম তুমি খুবই ফ্রেন্ডলি। আর এর আগেও তো তোমার সাথে কথা হতো। সত্যি বলতে যখন তোমার সাথে কথা বলতাম, তখন না হেসে পারতাম না। মনে হতো জীবনটা সত্যিই একটা উপভোগের বিষয়। তাই, কষ্ট ভুলে থাকতেই তোমার সাথে কথা বলতাম।”
“সব বুঝলাম। কিন্তু, তুমি আমার সাথে এমনসব আশ্চর্য কান্ডকারখানা করতেছ কেন?”
“আমি এই জীবনে কেবল দুইটা ছেলের মায়া অনুভব করেছি। প্রথমত নিলয়। অন্যজন তুমি। তাই, তোমার অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলা, তামাশা করাটা আমি সয়তে পারতাম না। কেমন যেন লাগতো। যদিও তুমি তেমন কোনো মতলব নিয়ে কথা বলতে না। তবুও, আমার কাছে তা বিষের মতো মনে হতো। তাই, তোমাকে আমি একান্ত আমার করে নিতে চাই। এই জন্যে, তোমাকে আমার জগৎে আসতে হবে। এবং তাও খুব শিঘ্রই চলে আসবে। আমার হয়ে যাবে। একান্ত আমার। হা, হা, হা! নিলয়কে যেভাবে হারিয়েছি, তোমাকে সেভাবে হারাতে চায় না আমি। কারণ, নাজাতের মায়া থেকে ছাড় পাওয়া সহজ। কিন্তু, পেত্নীর মায়ার বাধন ছিন্ন করা সম্ভব নয়।”
“কিন্তু, আমার মতো একটা ফাজিল ছেলেকে তো ভালোবাসা যায় না। সবটা নিয়েই আমি ফান করি, তামাশা করি। দেখো। ভালোবাসাটা সিরিয়াসলি নিতে হয়। যা আমার সাথে যায় না। সত্যি বলতে, আমার কাছে ভালোবাসা মানেই ছেলেখেলা বলে মনে হয়। এখনকার ভালোবাসার সবটায় ক্ষণিকের মায়া। আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না।”
“অমনটা তুমি যতই বলো, ভালোবাসা নিয়ে তোমার ভাব কেমন আমি ভালো করেই জানি।”
“কিভাবে?”
“তোমার একটা উপন্যাস আমি পড়েছিলাম। “মায়াবিনী মায়া”। ঐ উপন্যাসে তুমি তোমার ভাবটা লিখেছিলে। লেখকের মন বোঝার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো তার লেখনী। ঐ উপন্যাসটা পরেই আমি বুঝেছিলাম, সত্যিকার অর্থে তোমাকে ভালোবাসা যায়। যতই ফাজিল হওনা কেন, মনটা তোমার বরাবরই সুন্দর।”
“তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু, তুমি যদি মানুষ হতে, তবে না হয় তোমায় ভালোবাসা যেত। কিন্তু পেত্নির সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই, দয়া করে আমাকে একা ছাড়ো।”
মেয়েটার কাছ থেকে আমি যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করছি। আমি এসব থেকে মুক্তি চাই। নাজাত বলে,
“না। আমি তোমাকে চাই-ই। আর এমনই অবৈধ ভাবেই! আসলে কী বলতো, একবার যদি এই অবৈধ জালে বন্দি হয়ে যায় তবে এ থেকে বাঁচা মুশকিল। কেবল সে তার ভালোবাসাকে অবৈধ ভাবেই পেতে চায়। তোমাকে আমি তোমার মত করেই ভালোবাসব। শুধু আমার এই জগতে আসো। তোমাকে যে আমার পেতেই হবে।”
“প্লিজ, নাজাত। তুমি নিজেকে শেষ করে দিয়েছ। এটা তোমারই ভুল। কিন্তু, আমি বাঁচতে চাই। তুমি আমাকে মুক্তি দাও। দেখো, তুমি পেত্নী। আর আমি মানুষ। দুজনের মধ্যে এটা কখনোই সম্ভব নয়। আর, আমি তোমার জগতে যেতে চাই না। আমি এই পৃথিবীকে ভালোবেসে এখানেই থাকতে চাই। যতদিন বাঁচি। প্লিজ, আমার মুক্তি দাও। প্লিজ।”
“মুক্তি!”
শব্দটা যেন তাকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করেছে।
L
“ওকে। যাও। তুমি মুক্ত। আর কখনো তোমাকে ডিস্টার্ব করব না। তবে জেনে রেখো এই পেত্নী তোমাকে অবৈধ ভাবে পেতে চাইলেও পেত্নীর ভালোবাসাটা সত্য ছিল। বিদায়। বিদায়…….”
মেয়েটি ঢুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর ক্রমশ হারিয়ে যায়। আর আমাকে নিচে নামিয়ে দেয়।
এরপর থেকে আর কখনো ওমন নাম্বার থেকে কল আসেনি। কারণ, চোখটা বোজে এসেছিল।
✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪
আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। ডানপাশে ইসিজি মেশিনে হার্টবিটের চার্ট উঠা নামা করছে। রাতে স্লিপিং ওয়াকে ছাদ থেকে পেকে গিয়েছিলাম নাকি। কিছুই মনে নেয়।
আজ সত্যি সত্যিই নিলয়ের বিয়ে। তবে কার সাথে তা আমি সত্যিই জানিনা। বেডের পাশে তার বিয়ের কার্ড। খুলে দেখার শক্তি আমার নেয়।
মোবাইল বাজছে। একটু দূরে ছোট ডেক্সের উপর। নাম্বারটা দেখার সামর্থও আমার নেয়।
ইসিজি এর চার্টের দিকে এক নজরে চেয়ে আছি। হার্টবিট ক্রমশ কমছে। চোখটাও বোজে আসছে। হয়ত চিরতরের জন্য!
কেউ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরছে বলে মনে হচ্ছে। কোমল হাত। হয়তো নারীর। তবে অদৃশ্য! এই জড়িয়ে ধরায় আছে ভালোবাসার ছোয়া। হয়তো বা বড্ড ভালোবেসেছে আমার।
গভীর ভাবে………!