পড়ন্ত বিকেলে বারান্দায় বসে পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখছে ছোট্ট ইরিন।বয়স আর কতই বা হবে সবেমাত্র ক্লাস ৪ এ উঠেছে। খুব শান্তশিষ্ট ভদ্র একটা মেয়ে।বাবা মায়ের নয়নের মনি।ভাই আনান,বাবা-মা নিয়েই তাদের ছোট্ট পরিবার।তার বাবা যথেষ্ট ধার্মিক, বিধিনিষেধ পালনে কঠোর বলেই তাদের এই ছোট্ট পরিবারে ইসলামের ছোয়া রয়েছে পুরোপুরি।ইরিনও তাই ছোট্ট থেকে হিজাব পড়া শিখে নেই,আর নামাজও নিয়মিত।ছোট থেকেই সেও ইসলাম সম্পর্কে অনেক জ্ঞান আহরণ করেছে।

আগামীকাল সকালে তার বাবা-মা ইন্ডিয়াই যাবে ইরিনের আব্বুকে ডাক্তার দেখানোর জন্য।ইরিনের বাবা খুব ভালো এবং সৎ একজন মানুষ,তাই তাকে সকলেই ভালোবাসে।তার বন্ধু আত্বীয় স্বজনের অভাব নেই। কিন্তু তাঁর এক হৃদযন্ত্রের অসুখ তাকে সবকিছু থেকে কাবু করে ফেলেছে। মানুষ টা দিন দিন মৃত্যুর দিকে ডলে পড়ছে।কিন্তু কার ইচ্ছে করে এত্ত সুন্দর একটা পরিবার ছেড়ে বহুদূরে চলে যেতে।কিন্তু মত্যু তো অনিবার্য।এটা মাথায় রেখে উনি তাঁর আদরের ইরিন-আনান কে সান্ত্বনা দেন।একটুখানি ছেলেমেয়ে আর কদ্দুরই বা বুঝে..!

আগামীকাল চলে যাবে বিধায় অনেক মেহমান আসলো রাতে। সবকিছু চুকিয়ে তার মা নামাজ পড়ে ঘুমোতে গেল। ইরিনও ঘুমে বিভোর।সকাল বেলা নিয়ম করে তার বাবা তাদেরকে ফজরের নামাজের জন্য ডেকে দিত।আজকেও তাই হলো। বাবার ডাকে আদরের ইরিন আড়মোড়া ভেংগে ঘুম থেকে উঠলো।নামাজ আর কোরআন পড়ে সে পড়তে বসে গেল।সময় ঘনিয়ে আসলো তার নানুও বাসায় চলে আসলো।নানু আসার কারণ মূলত তার আব্বু আম্মু ইন্ডিয়াই চলে গেলে তার কাছেই রেখে দিয়ে যাবেন।

অবশেষে তারা বেড়িয়ে পড়লো। ইরিন আর আনান এয়ারপোর্ট পযর্ন্ত গেল তাদের প্রিয় দুটো মানুষকে বিদায় দিতে।তাদের কান্না সহ্য করার ক্ষমতা হইতো কারোরই নেই।কিন্তু বাবাকে সুস্থ দেখতে হলে তো যেতেই হবে।প্রিয় আব্বু আম্মুকে বিদায় দিয়ে তারা মামার সাথে বাসাই ফিরে এসেছে।এভাবে করে কয়েকদিন কেটে গেলো। ১ মাস পর বাবা মা ফিরে আসলো।
সবাই আজকে আনন্দ করে খাওয়া দাওয়া করলো অনেকদিন পর।

ইরিন তার আব্বু কে বললো,আব্বু তোমাকে কি আবার যেতে হবে?
-হুম, মা সুস্থ হতে হলে চেক আপ করাতে হবে নিয়মিত।
-আব্বু আমার জন্য কি এনেছ?
-আমার মেয়ের জন্য তো আমি অনেক গুলো চকলেট এনেছি,বোরকা এনেছি
-শুকরিয়া আব্বু! (খুশি হয়ে ইরিন বললো)
-আব্বু এবার তুমি ঘুমাও অনেক টায়ার্ড লাগছে নিশ্চয়ই।
-হুম আম্মু!
এভাবে করেই দিন পার হতে লাগলো। মাঝে মাঝে চেক আপ করানোর জন্য মানুষ টাকে ঢাকায়ও যেতে হয়েছিল।দেখতে দেখতে ইরিন ক্লাস ফাইভে উঠে গেছে..এদিকে তার বাবার অবস্থাও দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো।

হঠাৎ একদিন তার আব্বু তাদের দুই ভাইবোনকে ডেকে বললো-
-দেখ! আমি আর কতদিন বাচিঁ জানি না।তবে খেয়াল রাখবে আমি চলে গেলে কোনো মানুষের কাছে কিছু চাইবে না।কারো কাছে হাত পাতবে না,শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করবে।আল্লাহই তোমাদের দেখবেন।আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে তোমাদের ছেড়ে দিলাম।আল্লাহ ভরসা।
-আব্বু এমন কেন বলছ!(কাঁদতে কাদঁতে তারা বাবাকে বললো)
অপর পাশে তার মাও কান্না করছে।তার কিছুদিন পর থেকেই তার বাবার অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো।সারারাত মানুষ টা ঘুমাতো না,,ঘুমাতো না বললে ভুল হবে ঘুম আসতো না।তাই তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন একটু দেখার জন্য কি হলো, কিন্তু ডাক্তার তার অবস্থা দেখেই তাকে ভর্তি করিয়ে দিল…ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে তিনি ইরিন দের বলে গেলেন,আমি আবার চলে আসবো ইন শা আল্লাহ। তোমরা মন দিয়ে পড়ালেখা করিও। আল্লাহর উপর ভরসা করিও।
এরপর তার অবস্থা দিন দিন এতই খারাপ হয়ে যাচ্ছ যে কেবিন থেকে আস্তে আস্তে ICU ও CCU তে ভর্তি করতে হয়েছে,সাথে ছিল তার স্ত্রী,ইরিনের মা।তিনি সবসময় সব অবস্থাতেই এই মানুষ টার সাথে থাকেন।

এদিকে ইরিন তার ভাইকে নিয়ে নানুর কাছেই আছে।নানুও তাদের মায়ের মতো আগলে রাখেন।একদিন দুদিন করে সময় যেতে লাগলো, এরপর আব্বু আর না পারতে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।।এম্বুলেন্স করে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ঢাকায় যাওয়ার আগে ইরিনের সাথে শেষ কিছু কথা হয়ে ছিল যা ছিল সংক্ষিপ্ত। যেটা ইরিন সারাজীবনই মনে রেখেছে।

শুক্রবারের দিন সকাল বেলা উঠে ইরিন পড়তে বসেছে।হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ,তার ফুফু আর ফুফাতো বোন এসেছে।সে দরজা খুলে বললো আব্বু ঢাকায় পৌছে গেছে,এবার ইন শা আল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে।এটা শুনে ইরিনকে ফুফু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।একে একে ঘরে মেহমান আসতে থাকলো বুঝলোই না কেন আসছে!

ইরিনও সবার জন্য চা বানাতে ব্যস্ত! ছোট্ট মন বুঝতেই পারছে না কি হয়েছে। সে ভাবছে আব্বু ঘরে নাই তাই হইতো তাদেরকে সবাই দেখতে আসছে।এরপর একটা আন্টি থেকে আনান কি যেন শুনেছে, শুনেই কান্না করে দিলো!ইরিন কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে গেলে তার ভাই বলে,

-আপু আব্বু তো আর নাইইই
-কিহহহ!!

শুনেই দুইজনেই কান্নায় ভেংগে পড়লো।বুঝতেই পারেনি তাদের প্রিয় আব্বুটা এত তাড়াতাড়ি তাদের ছেড়ে চলে যাবে!
এখন কে তাকে আম্মু ডাকবে,কে তার শত আবদার পূরণ করবে..!?
এরপর তারা সকলে বাড়িতে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো।কারণ রাতে আব্বুর জানাযা হবে বাড়িতে।যাওয়ার পথে আব্বুর জন্য কবর খুড়তে দেখে ছোট ইরিনের বুক টা চিন করে উঠলো..!শুকনো মুখটা আবারো কান্নায় ভিজে গেল।বাড়িতে গিয়ে দেখে সব আত্বীয় স্বজন এসেছে সবাই তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।পাশে শুধু নেই তার আম্মু আর আব্বু,,আব্বু তো না ফেরার দেশে চলে গেলেন।এদিকে আম্মু ঢাকা থেকে আসার পথে,তার অবস্থাও খারাপ।একবার সেন্স হারাচ্ছে আবার ফিরছে আবার হারাচ্ছে..।

সন্ধ্যা ৭ টায় তার আম্মু চলে আসেন।ইরিন-আনান দুজনেই আবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।পুরো বাড়িতেই যেন কান্নার রোল পড়েছে..!এরপর কিছুক্ষণ পড়েই তার বাবার লাশ টাকে আনা হলো..শেষ বারের মত ইরিন আর মা বাবাকে ছুয়ে দেখলো,লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় ইরিনের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়।সব শেষ হয়ে গেল..!

লাশ দাফন হয়ে গেলো…চলে গেলো তাদের প্রিয় আব্বু টা…।শুরু হলো তাদের নতুন এক জীবন। নতুন এক যুদ্ধ…!একটার পর একটা পরীক্ষা!

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।টিনের চালের ফুটো থেকে পানির ফোটা পড়ে ঘুমন্ত ইরিনের চোখ সজাগ হয়ে যায়।পাশে কাউকে না পেয়েই কিছুটা অবাক হলো।কারণ প্রতিদিন তার মা শিরিন সুলতানা,তাকে ঘুম থেকে ডেকে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে তারপর তার কর্মক্ষেত্রে যান।আজকে ব্যতিক্রম বলে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক! পরক্ষণেই বুঝে গেল রাতে দেরিতে ঘুম যাওয়ায় সকালে উঠতে পারে নি।আর এদিকে ফজর পড়েই চোখ লেগে এসেছিল।

যাই হোক ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে পড়তে বসে গেল ইরিনমনি টা!সে এখন ক্লাস ৬ এ উঠেছে।এই এক বছরে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে তাদের সেই ছোট্ট পরিবারে।বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তারা সেই আলিশান ঘর ফেলে নানুবাড়ির ছাদে একজন আংকেল যিনি তার আব্বুর বিশ্বস্ত বন্ধু, তিনি একটা ছোট্ট এক রুমের সেমিপাকা বাসা করে দেন।এটাই তাদের জন্য অনেক।কারণ ইরিনের আব্বু দ্বীনের পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজের পকেটে কোনো জিনিসই রাখেন নি!যার কারণে তাদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেন নি।যাই হোক আল্লাহ তো ব্যবস্থা করেই দিয়েছেন সেটা যেমনই হোক না কেন..!

তার মা,শিরিন সুলতানা একটা স্কুলে টিচার হিসেবে জয়েন করেছেন তার স্বামীর মৃত্যুর কয়েকমাস পর।এই অল্প ৫/৬ হাজারের বেতনে কোনোমতে তাদের সংসার চলে।কিন্তু পাহাড়সমান ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, পুরা একটা সংসার চালাতে থাকে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়।টিনের ঘরের ফাঁক দিয়ে প্রতিনিয়ত পানি পড়ে ঘর ভিজে যায়, যেখানে আগে ছিল তারা অনেক বড় ফ্ল্যাটে!এগুলাই আল্লাহর পরীক্ষা!

এখন তাদের পাশে নেই কোনো আত্বীয়স্বজন, নেই কোনো বন্ধুবান্ধব..সবাই মানুষ টা মারা যাওয়ার সাথে সাথে পর হয়ে গেল..!
আসলে তারা ছিল সুখের দিনের বন্ধু, এই দুঃখীদের আল্লাহ ছাড়া কেউই নেই।এখন ইরিন বুঝতে পারে সেদিন তার আব্বু কেন বলেছিলেন কারো কাছে কিছু না চাইতে,কেউ তাদের দেখবে না শুধু আল্লাহই দেখবেন।

তবে এই সব কষ্টের মধ্য দিয়ে তাদের বাবার পরে যে চাচা আছেন তিনিই তাদের সাথে বেইমানি করা শুরু করলো… তাদের কে বাড়ি আসতে নিষেধ করে দেওয়া হলো,,বঞ্চিত করা হলো সব কিছু থেকে।
এমনই একদিন….

ইরিন, আনান আর তাদের মা মিলে দাদুবাড়িতে গেলো ঈদ উপলক্ষে।তার চাচা তাদের তো দেখেই মাথা গরম করে ফেলেছিল…বললো..

-তোমরা এখানে কেন এসেছ?
-আমাদের বাড়ি..আর আমরা আসবো না?(কান্না বিজারিত কন্ঠে আনান বললো)
-না তোরা এখানে আসবি না, আমার ভাই যেহেতু নাই, মারা গেছে তোদেরও আর কোনো অধিকার নাই এখানে… চলে যা এখান থেকে…!

পাহাড় সমান আশা নিয়ে,আব্বু ছাড়া প্রথম ঈদ করবে বলে এসেছিল অবুঝ ইরিন-আনান!কিন্তু দুনিয়ার এই নির্মম হৃদয়ের মানুষ গুলোর জন্য আশা গুলো নিরাশাই রয়ে গেলো..!

তার চাচা রহিম সাহেবের একটাই কথা, তার ভাইয়ের ছেলে মেয়ে আসতে পারবে তবে তাদের মা শিরিন সুলতানা আসতে পারবেন না।কারণ তিনি চান এই অবুঝদের থেকে তাদের মা কে আলাদা করে সমস্ত সম্পত্তি দখল করবেন..!

ইরিনরা হইতো চাইলে পারতো আশেপাশের মানুষকে ডেকে তাদের হক আদায় করতে..কিন্তু শিরিন সুলতানা তা করেন নি।মান সম্মানের ভয়ে..কেননা যেখানে স্বামীর নিজের ভাই এমন করছে সেখানে বাইরের মানুষ এর থেকে আর কিই বা আশা করা যায়..???

তাই ইরিনের মা শিরিন সুলতানা অন্তত সম্পর্ক রাখার জন্য ছেলে আনান কে দুই ঈদে বাড়িতে পাঠান।ছোট্ট আনানও যেতে না চাইলেও যেতে হয়। তারও ইচ্ছা করে যেন আব্বু কে না পেলেও আম্মু যেন ঈদের দিন পাশে থাকে। হাজার হোক ঈদ যা মুসলমান দের জন্য অনেক বড় একটা উৎসব যেখানে সব অভিমান ভুলে সবাই এক হয়।কিন্তু ইরিনদের জীবনে ঈদ তার আব্বু মারা যাওয়ার দিনই চলে গেল।ইরিন আর তার মা মন মরা হয়ে নানুবাড়িতে ঈদের দিন পড়ে থাকে আর একলা বাড়িতে যায় আনান।

এভাবেই তাদের দিন কাটতে থাকে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে ইরিন আর আনান।ইরিন হয়ে যায় ১৫ বছরের এক কিশোরী,চলতে থাকে শিরিন সুলতানার এক ভয়ংকর যুদ্ধ। দাদুবাড়ির কোনো মানুষের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না এতদিন ধরে।

এদিকে ইরিন যখন তার বান্ধবীদের দেখে তারা তাদের কাজিন নিয়ে কত মজা করে, গল্প করে ঘুরে বেড়াই সব কিছু থেকে সে বঞ্চিত হয়। মনের মধ্যে জমে যায় অনেক অনেক কষ্ট!
তাও সে একটা দিক ভেবে সে নিজেকে শান্তি দেই আর যেটা আল্লাহই তাকে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন..

আর সেটা হলো পর্দা!

ইরিনের দাদুবাড়ির মানুষ গুলোর কেউই পর্দা করে না,এমন কি তারা মডার্ণ ফ্যামিলির পর্দা সম্পর্কে তারা জ্ঞান থাকলেও পাত্তা দেই নাহ…তাই তারা একসাথে সব কাজিন ছেলে মেয়ে মিলে গান বাজনা, গল্প গুজবে পড়ে থাকে….কিন্তু ইরিন দুনিয়াবি সামান্য এই কষ্ট পেলেও আল্লাহ তাকে আখিরাতে সুখ দেওয়ার জন্য হাজার হাজার গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখছেন আলহামদুলিল্লাহ!!
তাও আবার আল্লাহ নিজ হাতে তাকে বাঁচাচ্ছেন.. ওই যে তার বাবা বলেছেন আল্লাহর উপর ভরসা করে ছেড়ে দিলাম তোমাদের…এখন ইরিন দের আল্লাহই দেখছেন সুবহানাল্লাহ…

তবুও মাঝে মাঝে ইরিন জায়নামাজ এ বসে কাঁদে,তার রক্তের মানুষ দের জন্য,হাজার হোক তারা তাকে তাড়িয়ে দিলেও,তারা খারাপ হতে পারলেও, এই অবুঝ মন তো আর খারাপ না…! সে তো চাই যেন সব ঠিক হয়ে যায়।কিন্তু মানু্ষ গুলো যে বড়ই স্বার্থপর…!

এই বয়সে মেয়েরা চাই কেউ যেন তার বন্ধু হয় যে সব থেকে কাছের হবে,মনের কথা বলবে। কিন্তু ইরিনের কেউই নেই।নানুবাড়িতে কোনো বোন বা কাজিন নেই বলে সে এক প্রকার একাইই..তাই আল্লাহর কাছে সে সব সময় চাইতো যেন এমন এক বান্ধবী কে পাই যে তার সত্যিই বোন হবে..!

❝নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি।❞(আল ইনশিরাহঃ৬)

এটাই ভেবে ভেবে দিন পার করে ইরিন।আল্লাহ একদিন তাদের ভরে দিবেন ইন শা আল্লাহ।আর এই দুনিয়াটা মুমিন দের জন্য কারাগার।আল্লাহ তার পছন্দের বান্দাদেরই তো পরীক্ষা করে থাকেন।হইতো তাদের পরীক্ষা করছেন আল্লাহ…সুখে হোক দুঃখে হোক বান্দা রবকে মনে রাখছে কিনা!

সকাল থেকে উঠেই মা শিরিন সুলতানা ইরিনদের নিয়ে ঘর গোছাতে নেমে পড়েছে।সব কাপড় চোপড় আর তাদের অল্প জিনিসগুলো ব্যাগে ঢুকিয়েনিচ্ছেন।আর বড় বড় জিনিস গুলো মিস্ত্রী নিয়ে যাচ্ছে।

গোছাতে গোছাতে তিনি ইরিন কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-দেখেছিস আল্লাহ কত সুন্দর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আমাদের! এতদিনের টিনের চাল আর এর রুমের কারনে যে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তা থেকে আমাদের রেহাই দিয়েছেন।
-জ্বী আম্মু! আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন বলেই এত কষ্টের পর সুখ দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
-হুম এজন্য আল্লাহ কে কখনো ভুলা যাবে না, সুখে দুঃখে তাকে সবসময় স্মরণে রাখতে হবে।

হঠাৎ আনান এসে পড়ে তাদের কথার মাঝে…
-আম্মু তাহলে আজকে থেকে আমরা অনেক শান্তিতে থাকবো না??(খুশি হয়ে)
-ইন শা আল্লাহ! এখন থেকে বেশি করে দোয়া করবি যেন আমাদের আর কোনো সমস্যা না হয়!শুধু তোদের দাদুর বাড়িতেই যাওয়া হলো না রে..(চোখ ভিজে গেলো শিরিন সুলতানা’র)
-(ইরিন বললো) থাক,আম্মু আর বলিও না ওইসব কথা। শুধু শুধু তাদের কথা চিন্তা করে নিজেদের সুখ কে বিসর্জন দেওয়ার কি দরকার?
থাকুক তারা তাদের মতোই, তাদের যেমন আমাদেরকে দরকার পড়ে না আমাদেরও দরকার নেই তাদের..!আল্লাহ কপালে যতটুকু রিজিক রেখেছেন,যতটুকু হক আদায়ের ক্ষমতা দিয়েছেন আমরা শুধু ততটুকুই প্রাপ্য হবো..তার চাইতে এক কোণা বেশিও না!

ইরিনের কথায় শিরিন সুলতানার চোখ ভিজে কান্না আসতে চাইলো..! কিন্তু তার এই বাচ্চাদের সামনে কান্না করে নিজেকে দুর্বল করতে চান নি।কেননা তিনি দুর্বল হলেই এরাও ভেংগে পড়বে! তাই শত কষ্টের মাঝে শক্ত থাকেন মা শিরিন সুলতানা!

ইরিনের মেঝ মামা উপরের তলায় যেখানে ইরিনদের ঘর ছিল সেখানে ঘর করতে চাচ্ছন।তাই বাধ্য হয়েই তার নানু তাদেরকে নিচ তলায় দুটো ঘরের ব্যবস্থা করে দেন যেখানে আগে তার মেঝ মামারা থাকতেন।ফলে তাদের থাকার সুন্দর একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়,যেখানে এক রুমে তারা অনেক কষ্টে থাকতো এখন সেখানে দু রুম পেয়েছেন…।

এখন ইরিন আর তার মা একসাথে থাকেন একটা রুমে আর অন্য রুমে তার ভাই থাকে,আরেক রুমে তার নানু।তারা ভালোই দিন পার করছিল রহমানের দয়ায়!
কিন্তু সুখ বেশিদিন ঠিকে নাহ… দিন যত যায় নানুবাড়ির মানু্ষ গুলোও পর হয়ে যাচ্ছে..তারাও ক্ষণে ক্ষণে ইরিন দের সাথে খারাপ ব্যবহার করে,তাদেরকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার নানান ইংগিত দেন।যদিও সরাসরি বলেন না তারা।কিন্তু নিরুপায় শিরিন সুলতানা কি করবে ভেবে পায়না.. আল্লাহর উপর ভরসা করে, চুপ থেকে সহ্য করে যান সুন্দর দুনিয়ার অসুন্দর কিছু মানু্ষের ব্যবহার..!

তিনি মনে মনে ঠিক করে রাখেন,,ছেলেমেয়ে গুলো ভার্সিটিতে বা কোথাও একটা সেটেল হয়ে গেলেই তারপর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন।এখনো তারা এস এস সি পরিক্ষাও দেই নি। বড় হয়ে গেলে তারা নিজেরাই নিজেদের হক আদায় করতে পারবেন চাচার কাছ থেকে ইন শা আল্লাহ।ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকেন।

ইরিন মাঝে মাঝে তার আব্বুকে খুব মিস করে,তার আব্বুর আদর গুলো মনে করে তার চোখ দুটো অশ্রুতে ভেসে যায়।পৃথিবীতে প্রতিটা মেয়ে তার বাবার কাছে রাজকন্যা, তাদের ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না…।কিন্তু সে তার বাবাকে পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারে না বাবার ভালোবাসা টা আসলে কেমন!
ছোটবেলায় যখন রাতে ঘুম আসতো না তখন তার আব্বু তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত ঘুম না আসা পর্যন্ত।তার হাটতে কষ্ট হলেও হৃদযন্ত্রের অসুখে ভোগা মানুষটা মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটতো। এগুলা ভেবে তার চোখ ভিজে যায়…!

তার বিশ্বাস জান্নাতে তার আব্বুর সাথে তার অবশ্যই দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।

দিন যায় সময় যায়… ইরিনের এস এস সি পরিক্ষার আর বেশি সময় নেই।১সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা। মেয়েটা খুব মেধাবী।ররাবরই প্রতিটা পরীক্ষায় সে স্কুলে টপ করতো।তাই স্কুলেও তার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে।প্রতিটা টিচার ওকে ভালোবাসতো।তার সুন্দর গুণগুলো সবাইকে মোহিত করতো।সে ছোট বেলা থেকেই নামাজ, রোজা, পর্দা পালনে ছিল সচেষ্ট।যেখানেই যায় না কেন সে সবসময় কালো বোরকা হিজাব দিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখতো।যখন থেকে ইরিন পর্দার আয়াত সম্পর্কে জেনেছে তখন থেকেই সে ঘরে বাইরে পর্দা করেছে সুন্দর ভাবে।এমন কি তার ঘরে মামাতো ভাইরা আছে বলে থাকে ঘরেও পর্দা করতে হয়। এটা নিয়ে সে মাঝে মাঝে কষ্ট পায়,চোখের কোণা ভিজে যায়।কেননা মেয়েদের সচরাচর বিয়ের পরে ঘরে পর্দা করতে হয় এর আগ পর্যন্ত সে বাপের ঘরে ভালোই থাকতে পারে কিন্তু ইরিনের ক্ষেত্রে সেটা ভিন্ন…!

আবার পরক্ষণেই সে ❝আলহামদুলিল্লাহ❞ বলে। সে জানে, রাসুল (স) বলেন,❝দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেল খানা এবং কাফেরদের জন্য বেহেশতস্বরূপ।❞(তিরমিযী শরীফঃ ২২৬৬) তাছাড়া আল্লাহ তাকে এগুলো পরীক্ষা করছেন।

ফেব্রুয়ারী ২ তারিখ।আজ তার পরীক্ষা শুরু, সকাল থেকেই ইরিন পড়ছে।কেন্দ্রে যাওয়ার আগে সে দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো,যেন তার পাশে অন্য স্কুলের কোনো ছেলে না পড়ে।সে এটা নিয়ে বেশিই ভয়ে আছে।বুঝতে পারছে না যদি সিট পড়ে যায় সে কিভাবে পর্দা মেইনটেইন করবে তাছাড়া ছেলেরা কথা বলতে চাইলেই বা ও কি করবে? এই টেনশনেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

মাথা ভর্তি টেনশন নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে গেল ইরিন। হলে ঢুকে সিট প্ল্যান দেখে বিমোহিত হয়ে গেলো।রবের কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো।আল্লাহ তার পর্দা নিজ হাতে বাঁচান সবসময়ই। তার পাশের রুম থেকে ছেলেদের সিট পড়েছে।তার জলে সব মেয়ে।আলহামদুলিল্লাহ।

সে সুন্দর করে সব পরীক্ষা দিলো আর খুব ভালোই পরীক্ষা দিয়েছে সে।

একে একে পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো পরীক্ষার পরে লম্বা এক ছুটি পেল।সে ঠিক করেছে সে সহিহ করে কোরআন শিখাই এমন কোথাও ভর্তি হবে।যদিও সে কোরআন পড়তে জানে তাও তার ভয় হয় তার মাখরাজ গুলো সঠিক হচ্ছে কিনা। বা কোথাও পড়তে গিয়ে উচ্চারণ ভুল করে ফেলছে কিনা।তাই সে তার বিষয় টি তার একটা ফ্রেন্ডকে কল দেই,

-আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছিস নিহা?
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আলহামদুলিল্লাহ তুই?
-হুম আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আচ্ছা শোননা আমি সহিহ করে কোরআন পড়া শিখতে চাচ্ছি কি করা যায়?
-তাই! তা তো ভালোই খবর।শোন, আমার কিছু পরিচিত আপু আছেন তারা প্রতি শুক্রবার সহিহ কোরআন শেখাই, পাশাপাশি কোরআনের অর্থ সহ তেলওয়াত করে বুঝিয়ে দেই।তুই চাইলে সেখানে বসতে পারস।
-বাহ! ভালোই তো।আচ্ছা আমাকে তাহলে কি করতে হবে আমি এখানে বসবো ইন শা আল্লাহ।
-আচ্ছা আমি তোর নাম্বার টা আপুকে দিব। তিনি তোকে ফোন দিবেন।
-আচ্ছা তাহলে আল্লাহ হাফেয আর শুকরিয়া।
-হুম আল্লাহ হাফেয।

ইরিন কথা বলে ফোন রেখে ছাদে উঠলো তার ছোট বাগানে পানি দিতে।এগুলাই তার সংগী।পানি দিতে দিতে ডুবে যায় তার বাগানের ছোট্ট ফুল গুলোর রাজ্যে। হঠাৎ তার ভাই আনান এসে বলে, ‘আপু তোমার ফোন বাজছে কতক্ষণ ধরে কই থাকো তুমি??’
ভাবনার রাজ্য থেকে ফিরে বলে,,,
-আমি তো ছাদে ছিলাম (বলেই ফোন রিসিভ করে ইরিন)

-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম, ইরিন আপু বলছেন?
-জ্বী আপনি?
-আমি নাদিয়া।আপনার ফ্রেন্ড নিহা নাম্বার টা দিয়েছে।
-ওহ আচ্ছা জ্বী বলেন।
-আপনি মনে হয় আমাদের সাথে তালিমে বসবেন বলেছেন।
-জ্বী।কখন থেকে বসতে হবে?
-এই তো আগামীকাল শুক্রবার কালকে বসা যায়।তবে আপনার সাথে আগে দেখা করতে পারলে ভালো হতো।
-জ্বী কিন্তু কিভাবে করা যায়?
-আচ্ছা আমি আপনাকে একটা জায়গায় দাড়াতে বলবো সেখানে আসবেন তারপর একসাথে যাবো আমরা ইন শা আল্লাহ
-আচ্ছা আপু
-আসসালামু আলাইকুম, আল্লাহ হাফেয।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।

এরপরের দিন ইরিন সেই আপুটার দেয়া ঠিকানায় যায়।আর তার সাথে তালিম এর এখানে যায়।খুব ভালো একটা দিন কাটে ইরিনের।অনেক কিছু শিখতে পারে ইরিন।আর সমবয়সী অনেক বোন থাকাই খুব ভালো দিন কেটেছে ইরিনের।
সে নাদিয়া মেয়েটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে।কথার ছলে জানতে পারে নাদিয়াও তার সমান। এই বছর এস এস সি দিয়েছে মাদ্রাসা থেকে।তার কথার ধরন দেখে ইরিনের খুব ভালো লাগে। আস্তে আস্তে ইরিন মেয়েটার সাথে কথা বলতে থাকে প্রায়ই সময়। আর নিয়মিত তালিম এ উপস্থিত থাকাই সে অনেক কিছু শিখেছে যা তার অজানা ছিল।

মেয়েটাও তার মতো দুঃখিনী।সাংসারিক অবস্থা ভালো না। বাবা আছে তাও তাকে নিজে টিউশন করে টাকা আয় করতে হয়।নিজের টা সে নিজেই চালায়।আস্তে আস্তে ইরিন আর নাদিয়া খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়।প্রাণের বন্ধু! প্রায়ই সময় তারা বাসায় আসা যাওয়া করে।এতদিনে ইরিন তার মনের মতো এক বোন,বন্ধু পেলো।যে শুধু তার বন্ধুই না বোনও।আর অলৌকিক ভাবে তাদের চেহারারও মিল রয়েছে।এমন কি কোথাও গেলে সবাই আগে বলে,’তোমরা কি বোন??’ হেসে উঠে দুই বান্ধবী,দুই বোন

কিন্তু হঠাৎ ইরিনের জীবনে ঘটে যায় এক চরম খারাপ অধ্যায়…সে বুঝতেই পারে না এমন কেন হলো।

ইরিন মোবাইল নিয়ে নেটে তার রেজাল্ট সার্জ করছে।আজকে তার এস এস সি’র রেজাল্ট প্রকাশিত হবে।সবাই একসাথে নেটে ভিড় করার কারণে রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছে না।টেনশনে ইরিনের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।মুখে বিড়বিড় করছে ‘আল্লাহ প্লিজ যেন ভালো কিছু হয়’….! কিছুক্ষণের মধ্যেই রেজাল্ট বের হয়ে গেলো।আলহামদুলিল্লাহ সে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে।রেজাল্ট দেখে ইরিন আল্লাহ’র শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো।সে জানে আল্লাহ সব সময় তাকেই বেশি দেয় যে পরিশ্রম করে।

ইরিন সঙ্গে সঙ্গে নাদিয়াকে ফোন দেই,
-আসসালামু আলাইকুম,রেজাল্ট কি পেয়েছিস?
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম! বাবারে বাবা তুই যে উত্তেজিত হয়ে আছিস(হাহাহা)
-হি হি হি, আরে বলনা..
-গোল্ডেন পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ! তা আপনি যে উত্তেজিত মনে তো হচ্ছে শুধু গোল্ডেন না সিলভার পাইছেন..হে হে
-ধুর কি সে বলিস! আজকে আমার বাসায় আয় বিরিয়ানি রান্না করবো দুই বোন মিলে! তাড়াতাড়ি আয়
-কিহ! আজকে??.
-দেখ কোনো অজুহাত শুনবো না অন্তত আজকে!!
-আচ্ছা আপাজান আসছি অপেক্ষা করেন
-এই তো গুড গার্ল, আচ্ছা আয় তাহলে
-হুম,আসছি। আল্লাহ হাফেয।

ইরিন আজ খুব খুশি।ফোন রেখেই তাড়াতাড়ি লিস্ট লিখে দেয় আনান কে বিরিয়ানি রান্নার জন্য।কিছুক্ষণ পর নাদিয়াও এসে যায়। শিরিন সুলতানা নাদিয়াকে দেখে খুব খুশি হয়েছেন। বললেন, “আজকে আমার দুই মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে।তাই আজকে খুব মজা কিরে বিরিয়ানি রান্না হবে ইন শা আল্লাহ।”

তিনজনই হেসে টুইটম্ভুর! আনানও বাজার নিয়ে হাজির। সবাই রান্না বানার কাজে লেগে পড়ে। দ্রুত হাতের কাজ শেষে তারা নামাজ সেরে নেয়।এবার খাওয়া দাওয়ার পালা।খুব তৃপ্তি ভরে তারা আজকের দিন টা বিরিয়ানি দিয়ে উপভোগ করলো। এরপর দুজনেই শুয়ে শুয়ে গল্প করছে দুই বান্ধবীর যেন কথার শেষ নাই।একটার পর একটা টপিক করতে করতে কই যে চলে যায় তারা নিজেও বুঝে না।

বিকালে চা নাস্তা খেয়ে নাদিয়া চলে গেল।নাদিয়া যে ইরিনের মনের কোথায় তা হইতো ইরিন নিজেও জানে না।নাদিয়াও সেইম। দুজনেই দুজনের জন্য পাগল।যেখানে যায় একসাথে যায়।ঘুরে ফিরে মজা করে।ইরিন সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রবের কাছে। না চাইতেও তিনি এমন এক বোন দিলেন,যাকে সে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে।

হাদিসে কুদসিতে এসেছে,আল্লাহ বলেন, ❝আমার জন্য পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারী, পরস্পর উঠা-বসাকারী,পরস্পর সাক্ষাৎকারী,পরস্পর ব্যয়কারীর জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত।❞
[মুসনাদে আহমাদ]

কিছুদিন পরেই ইরিন কলেজের আবেদন শুরু হয়ে যায়।সে অনলি মেয়েদের এলাউড এমন কলেজে চয়েজ দেয়। আর আলহামদুলিল্লাহ সে মেয়েদের সরকারি কলেজে চলে আসে।এটা তার জন্য অনেক সৌভাগ্যের।কেননা ইরিন মোটেও ফ্রি মিক্সিং পড়াশোনা পছন্দ করে না।তাই সে রবের কাছে হাত তুলে দোয়া করে এতো সহজে তার দোয়া কবুল করার জন্য!

কলেজে ভর্তির পরেই অনেক ফ্রেন্ড কে সে অনলাইনে পেয়ে যায় যারা তার সাথে সেইম কলেজেই পড়ে।কিছু কিছু মেয়ের সাথে সে কথাও বলে। তাই অনেকের সাথে তার পরিচয় হলো।এরই কিছুদিন পর একটা অপরিচিত আইডি থেকে ইরিনের মেসেজ আসে,
“আসসালামু আলাইকুম।শুধু মাহরাম দের আইডিতে এড করবেন কেন??”
এটা বলার কারণ তখন ইরিনের বায়োতে লেখা ছিল-

❝ননমাহরামরা মেসেজ দেওয়া থেকে দূরে থাকুন❞

মেসেজ দেখে একটু অবাক হলেও,মেয়ের আইডি দেখে ইরিন রিপ্লাই করলো। আর সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো যে পর্দা করতে হবে মাহরাম-ননমাহরাম মেনে।এভাবে করে টুকিটাকি কথা হয় মেয়েটার সাথে।আর পরিচিত হয়ে নেয়। মেয়েটার কথার ধরন দেখে মনে হতো যে সে অনেক ধার্মিক। তাই ইরিনের মোটামুটি ভালোই লাগে মেয়েটাকে।
আস্তে মেয়েটা ইরিন থেকে তার পছন্দ-অপছন্দ জেনে নেই।এভাবে তাদের মধ্যে প্রায়ই কথা হতো।মাঝে মাঝে ইরিনের অবাক লাগতো মেয়েটার কিছু অদ্ভুত জাতীয় প্রশ্ন দেখে..!

একদিন ইরিন নাদিয়ার বাসাই যাচ্ছে তালিমের জন্য।বাকি বোনেরা আসা পর্যন্ত ইরিন অপেক্ষা করে, অনলাইনে গিয়ে দেখে মেয়েটার আইডি অফ! সে তো অবাক।হঠাৎ কি হলো যে আইডি অফ করে দিবে।সে এতোকিছু আর না ভেবে নাদিয়ার সাথে গল্পে মশগুল হয়।এরপর বিকালে ফিরে ইরিন খাওয়া দাওয়া করে নামাজ পড়ে নেই।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে একটা অপরিচিত ছেলের পক্ষ থেকে মেসেজ আসলো।ছেলেটার নাম,নাইম হাসান।ছেলেটার মেসেজ দেখে ইরিন অবাক! সে টর টর করে ইরিন সম্পর্কে অনেক কথা মেসেজ আকারে দিয়ে দেয়। ইরিন ভাবলো ছেলেটা আমার সম্পর্কে এতোকিছু কিভাবে জানে।যেহেতু ছেলে সে রিপ্লাই না দিয়েই ফোন রেখে দেয়।

মাথায় কোনো ঝামেলা না নিয়েই সে পড়তে বসে যায়।পড়া শেষ করে ইরিন এশারের আযান দিলে নামাজ পড়ে সুরা মূলক পড়ে নেয়।সুরা মুলকের অনেক ফজিলত রয়েছে।তাই সে নিয়মিত এটা পাঠ করে।

সূরা মূলকের ফজিলত কি?
★হজরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;

“কোরআন শরীফে ৩০ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা আছে, যা তার তেলাওয়াতকারীকে ক্ষমা করে না দেয়া পর্যন্ত তার জন্য সুপারিশ করতেই থাকবে। সূরাটি হলো– তাবারাকাল্লাযী বি ইয়াদিহিল মূলক অর্থাৎ সূরা মূলক…।
(আবু দাউদ-১৪০২, তিরমিজি-২৮৯১]

★আর যে ব্যক্তি নিয়মিত সুরা মূলকের।আমল করবে সে কবরের আজাব থেকে মুক্তি পাবে।
[তিরমিজি-২৮৯০]

এরপর খাওয়া দাওয়া সেরে ইরিন মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ছেলেটার অনেক গুলো মেসেজ।
-উফফ!! কে এই ছেলে?? কেন এভাবে আমাকে বিরক্ত করছে বুঝছি না (মনে মনে বিরক্ত হয়ে)

এর আগেও অনেক ছেলে ইরিনকে মেসেজ দিত, ইরিন তা স্বাভাবিক ভাবেই ইগনোর করতো। কিন্তু এটা তার কাছে কেমন জানি হাইলাইট হচ্ছে বারবার। কেননা এই ছেলে টা তার সম্পর্কে এত কিছু কিভাবে জানে সেটা ভেবেই তার মাথা পাগল হয়ে যাচ্ছে।এর পর বিরক্ত হয়ে একেবারে ফোন রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।সকালে উঠে আর অনলাইনে আসে নি ইরিন।

সব কাজ টাজ সেরে বিকেলে যেই না মোবাইল হাতে নিল আবার সেই একি কান্ড!! কিন্তু এবারের কান্ড টা একটু ভিন্ন যা দেখে ইরিন হতবিম্ভ হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেক্ষণ… হঠাৎ মায়ের ডাকে হুশ ফিরে পায় ইরিন।
-কিরে ইরিন কি হয়েছে?
-কই আম্মু কিছু হয়নি,কিছু বলবে?
-নাহ এমনেই

ছেলেটার মেসেজে নিজের পরিচয় দেওয়ায়,বুঝতে পারে এটা সে অপরিচিত মেয়েটাই যার সাথে ইরিন কয়েকদিন ধরে কথা বলেছিল।ইরিন এবার কেন জানি রিপ্লাই দিয়ে দিলো,,
-তুমি মানে??
আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি সেই মেয়েটা??
-হ্যা আমি ওইটাই তবে মেয়ে না ছেলে…
-ইরিন বাকরুদ্ধ!!
-মানে?? আমি এতদিন একটা ছেলের সাথে কথা বলেছি??
-ইয়ে মানে আপনি খারাপ ভাবে নিচ্ছেন কেন।আমার আপনাকে ভালো লেগেছে তাই
-চুপ করেন আপনি…
-………..
-দেখেন আর কখনো আমাকে মেসেজ দিবেন না
-না শুনেন প্লিজ
-………..

ইরিনের পক্ষ থেকে আর কোনো মেসেজ যায় না।ইরিন মাত্রই ফেইসবুক চালু করেছে বিধায় সে ব্লক করতে পারা যায় সেটা জানা ছিল না। তাই সে এমনেই মেসেজ অপশন ডিলিট করে রেখে দেয়।ছেলেটা সমানেই মেসেজ পাঠাতেই থাকে…আর ইরিন সেটা সিন না করে ফেলে রাখে।এভাবেই যাচ্ছে কিছুদিন।
একদিন অগত্যা ইরিন মেসেজ গুলো সিন করে আর ছেলেটার কিছু আবেগপূর্ণ কথা তাকে, ছেলেটার প্রতি দূর্বল করে দেয়।তাও নিজেকে শক্ত রেখে মেসেজ দেয়-
-আপনি কেন আমাকে এভাবে মেসেজ দিচ্ছেন??
-(ছেলেটা বললো)…দেখুন আমি দ্রুত বিয়ে করতে চাচ্ছি আর আমার ফ্যামিলিও সাপোর্টিভ এই বিষয়ে।আর বিয়ের ক্ষেত্রে আমি যেমন ধার্মিক, পর্দাশীন যেমন চেয়েছি তেমন সব গুণই আপনার মধ্যে পেয়েছি। তাই আমি আপনাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। তবে আল্লাহর হুকুম থাকলে….
-আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু আপনি কি জানেন?? এভাবে আমাদের কথা বলা উচিত না??
-জ্বি জানি, তবে আমি আপনার সাথে কথা কন্টিনিউ করতে চাচ্ছি না জাস্ট মনের কথাটা বললাম

এভাবে করে তর্কে বিতর্কে তাদের মধ্যে কথোপকথন চলছে…..
ইরিন নাইম ছেলেটার এভাবে মেয়ের আইডি খোলা, মেয়েদের সাথে কথা বলা পছন্দ করে না তা বোঝাতে চাচ্ছে বারবার।ছেলেটাও ইরিনের পছন্দমতো,মন মতো হবে বলে বারবার আশ্বাস দিচ্ছে… কিন্তু ইরিনের মন কেমন জানি করছে…সে বার বার ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছে যে সে এই মুহুর্তে ছেলেটার সাথে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না..মন থেকে যখনই
এটা আসে আবার ছেলেটার এক রকম কথায় যে হাবুডুবু খাচ্ছে…(অর্থাৎ শয়তান ইরিন কে প্ররোচিত করছে)
এক পর্যায়ে ইরিন ছেলেটাকে প্রশ্ন করে ফেলে…
-আচ্ছা আপনি তো আমার চেহারাও দেখলেন না, আমি যদি অসুন্দর হয় তাহলে আপনার কি আমাকে পছন্দ হবে??

এই কথার উত্তরে ছেলেটা যা বললো তা শুনে ইরিন…….

শেয়ার করুন