‘ভেজা শরীর নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছো, লজ্জা করে না?’
সামনে দাঁড়ানো একজন সুগঠিত মানুষ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল। কথাটা শুনে বর্ষার মেজাজ খুব গরম হয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে সে ভ্রুকুটি করে, রাগে তার ঠোঁট কামড়ে ধরল। কঠিন গলায় লোকটি আবার একই প্রশ্ন করল,
‘চুপ করে আছো কেন? এই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?’
মাথা উপর বৃষ্টি, অন্ধকারে এই মানুষটির জিজ্ঞাসাবাদ। বর্ষা লোকটার দিকে তাকাল, অন্ধকারের কারণে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে সে বেশ লম্বা। পরিবারের সবচেয়ে ছোট মেয়ে, কেউ তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলে না। অথচ কতটা বেপরোয়াভাবে এই লোকটা ধমকাচ্ছেন।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। তারা কোচিং সেন্টার থেকে বাসায় যাচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। ঠান্ডা বাতাসে শরীর কাঁপছে। রাস্তার দোকানপাট বন্ধ। ঝড় আসবে টের পেয়ে দোকানিরা ঝাপ বন্ধ করে চলে গেছে। মাহিরা, অহিতা আর নিতু একটা দোকানের সামনে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গা থেকে দুই মিনিট হাঁটলেই একটি বাগান, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে ডাকাতরা ধরে বাগানে নিয়ে যায়। এমনটাই শোনা গেছে এলাকায়।
বর্ষা বৃষ্টি পছন্দ করে। বৃষ্টি হলেই সে ভিজে। কাঁচা রাস্তাগুলো বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত, গর্তে পানি জমে রাস্তাগুলো কাঁদা মাটিতে পরিণত হয়েছে। আকাশে বজ্রপাত নেই। বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ তার পিছনে একটি গাড়ি এসে থামল। আর একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছাতা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। লোকটির মনে হয় ভদ্রতার ন্যূনতম বোধের অভাব রয়েছে। বৃষ্টিতে ছুটে আসে মাহিরা। লোকটির উদ্দেশ্য বলল,
‘কেউ এভাবে গাড়ি চালায়? আরেকটু হলে দুর্ঘটনা হয়ে যেত।’
লোকটি তার আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘হ্যালো, আমি গাড়িটা তোমার বন্ধুদের সামনে আনিনি। তোমার বন্ধু আমার গাড়ির সামনে এসেছিল নিজে মরতে, মরতে চাইলে অন্যের গাড়ির নিচে যাক।’
লোকটির কথা বর্ষার কাছে খুবই অপমানজনক মনে হয়। সে ভ্রুকুটি করে মাহিরার কানে কিছু বলল। ফিসফিস করে জবাব দিল মাহিরা,
‘বড় অসভ্য লোকটাকে শিক্ষা দেওয়া উচিত।’
অন্ধকারে লোকটার মুখ দেখতে না পারলেও বর্ষা তার উচ্চতা আন্দাজ করল। হঠাৎ রাস্তার ধারে বসে একগুচ্ছ ভেজা মাটি হাতে তুলে নিল সে। ছুড়ে দিল লোকটার বুকে। আগন্তুক আঁতকে উঠল। চিৎকার করে বলল,
‘হোয়াট। তুমি এটা কি করেছ?’
বর্ষা তার বন্ধুদের সাথে দৌঁড়াতে থাকে। চার নারীদ্বয় অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুভ্র গাড়ির ভিতর থেকে বলল,
‘এই অভ্র চলে আয়, আর কতক্ষণ দাঁড়াবি?’
অভ্র তার চোয়াল চেপে ধরল। গাড়িতে বসে বলল,
‘এই কাঁদা শরীর নিয়ে বাড়ি যাব না। এত বছর পর দেশে এসে এই কাঁদা মাখা অবস্থা দেখে বাড়ির লোকজন অনেক প্রশ্ন করবে। আমি এর চেয়ে ভালো কাল যাব।’
শুভ্র জিজ্ঞেস করল,
‘তাহলে এখন কোথায় যাবি?’
‘কেন? তোর বাড়িতে।’
বারান্দায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করছে তিন্নি। বর্ষাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে দৌঁড়ে তোয়ালে নিয়ে নিচে এলো। বেল বাজতেই সদর দরজা খুলে দিল তিন্নি। তোয়ালেটা বাড়িয়ে বলল,
‘তুই দেখেছিস বৃষ্টি হচ্ছে, তবুও ভিজে এলি কেন?’
বর্ষা তাকাল। সাথে সাথে মুচকি হেসে বলল,
‘ভিজেছি কি আর সাধে আপু? কোচিং সেন্টার থেকে বের হয়ে মোল্লার দোকানে এলাম আর প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। তখন কি করব? তাই ভিজতে হলো। এছাড়া রাস্তায় একটি ঘটনাও ঘটেছে।’
তিন্নি নিজেই তোয়ালে দিয়ে বর্ষার মাথা মুছতে বলল,
‘কী হয়েছে?’
হাসিমুখে ঘটনাটি বলল বর্ষা। তিন্নি রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ লোকটা ভালো কথা বলেছে। তোর এটা করা উচিত হয়নি।’
‘কীভাবে ভালো বলেছে?’
‘বৃষ্টিতে ভিজছিস, জ্বর হলে বা মেয়ে দেখলে ছেলেরা যদি বিরক্ত করে, এই ভেবেই হয়তো বলেছে। আর তাছাড়া তোকে কতবার বলেছি বড়দের নাম ধরে ডাকবি না। মোল্লা নজরুল চাচা কি তোর ছোট? লোকটাকে মোল্লার দোকান বলে গালি দিস কেন?’
‘আপু, সবাই তো তাই বলে।’
‘তুই বলবি না।
চেয়ারে বসে আছেন নূর ইসলাম। গম্ভীর গলায় বললেন,
‘বৃষ্টিতে ভিজে এসেছ কেন? বৃষ্টি কমলে বা বাড়িতে ফোন দিলে গাড়ি পাঠানো যেত।’
বর্ষা বলল,
‘আমার ঠান্ডা লাগবে না দাদা। তুমি চিন্তা করো না শুধু এক কাপ চা খেলেই হবে।’
‘ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি রুমে যাও এবং ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরো। ঠান্ডা লাগলে সহজে ভালো হবে না।’
তিন্নি জিজ্ঞেস করলো,
‘রিমা কোথায়? একসঙ্গে কোচিং থেকে বের হননি?’
বর্ষা চলতে চলতে বলল,
‘ আসছে, পেছনে।
বর্ষা স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় পা রাখল। রিমা দুই কাপ চা নিয়ে রুমে এলো। বর্ষাকে খুঁজতে বারান্দায় গেল। এক কাপ চা তার হাতে দিল। বর্ষা জিজ্ঞেস করল,
‘ফোনে কি দেখছিস?’
রিমা হেসে বলল,
‘আজ আমার ফ্রেন্ডলিস্টে একটা কিউটের ডিব্বা এড হয়েছে।’
বর্ষা চায়ে ঠোঁট ডুবিয়েছে। তারপর হঠাৎ বলল,
‘রান্নাঘরের ডিব্বা ফেসবুকে গেল কীভাবে? রাস্তা কোথায় পেল?’
রিমা রেগে গিয়ে বলল,
‘আরে তুমি বুঝবে না। কিউটের দিব্বা মানে একটা কিউট ছেলে আমি এক সপ্তাহ আগে রিকুয়েস্ট করেছিলাম একটু আগেই মেনে নিচ্ছে।’
রিমা ফোনটা ধরিয়ে দিল বর্ষার দিকে। বর্ষা না তাকিয়ে বলল,
‘তুই হয়তো এসব বিষয়ে আগ্রহী কিন্তু আমি নই।’
গরম চা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। চায়ের কাপে চোখ স্থির রেখে বর্ষা মনে মনে বলল,
‘ওই লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে বকা দিচ্ছে। মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাইনি। যদি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেতাম, তাহলে পরের বার দেখা হলে সরি বলা যেত।’
হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। সে আয়নায় তার প্রতিবিম্বের দিকে কয়েকবার তাকাল, দুবার স্নান করেছে। তবে মাটির গন্ধ শরীর ছাড়ছে না। অভ্র আরো পারফিউম দিয়ে রুম থেকে চলে গেল। শুভ্র নাক ছিটকে বলল,
‘এত পারফিউম দিলি কেন? ঘর গন্ধ হয়ে গেছে।’
সাহিল বলল,
‘মনে হচ্ছে এক বোতল পারফিউম একবারেই শেষ করে ফেলবে।’
অভ্র বলল,
‘মাটির গন্ধ, এখনো আসছে শরীর থেকে।’
শুভ্র জোরে হেসে উঠল। বলল,
‘মেয়েদের সাথে ঝামেলা করতে নাই। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে না? তখন মেয়েরা থুতু দিয়ে দৌঁড়াতো আর এখনকার মেয়েরা কাঁদা।’
অভ্র রাগী গলায় বলল,
‘আমি তাকে ছাড়ব না।’
সাহিল জিজ্ঞেস করল,
‘মেয়েটা কি খুব সুন্দরী ছিল যে ছাড়বি না?’
অভ্র সোফার ছোট্ট বালিশটা সাহিলের দিকে ছুড়ে দিল। অভ্র শাহাদাত আঙুল নেড়ে বলল,
‘একদম চুপচাপ।’
শাহিল মুখ দিয়ে আওয়াজ করল। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘একটি সুন্দরী কাঁদা ছুঁড়ে গেল আর তুই এই অধমের কপালে বালিশ ছুঁড়ে ফেললি। ‘
শুভ্র বলল,
‘তুই আজ বাড়ি যাবি না। বাড়িতে ফোন কর এবং তাদের জানা। তারা হয়তো অপেক্ষা করছে।’
অভ্র সোফায় বসে বলল,
‘দেশে আসবো সেটা কেউ জানে না। সবাই কে সারপ্রাইজ দেব ভেবে এয়ারপোর্টে তোদের আসতে বলেছিলাম।’
সাহিল মুচকি হেসে বলল,
‘আর মেয়েটা তোকে সারপ্রাইজ করেছে।’
খান পরিবারের বড় ছেলে সারফরাজ খান অভ্র দেশে ফিরেছে। তার উপস্থিতি বাড়ির সবাইকে অবাক করে। আট বছর পর অভ্র সামনে থেকে সবাইকে দেখছে। মা-বাবা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি সবার চোখে জল। মুহুর্তের মধ্যে খান বাড়িতে উদযাপন এবং খাবার তৈরি করা শুরু হয়। অভ্র যা খেতে পছন্দ করে তাই রান্না হবে আজকের খাবারে।
খান বাড়ির দক্ষিণ পাশে বিশাল ফুলের বাগান। বর্ষা চুপ করে বসে আছে। রিমা করুণ গলায় বলল,
‘এত বছর পর অভ্র ভাই দেশে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। তাছাড়া অভ্র ভাই আসছেন, রান্নাঘরে অনেক রান্না হচ্ছে দেখে আমি ভীষণ খুশি, তাই শুধু এক টুকরো ভাজা ইলিশ চেয়েছিলাম, মা বা চাচি কেউই আমাকে এক টুকরো দেননি। উল্টো তিনি বললেন, অভ্র না খাওয়া পর্যন্ত কেউ পাবে না।’
রিমা রাগে কপালে থাপ্পড় দিল।
বর্ষা কর্কশ গলায় বলল,
‘অভ্র ভাইকে ঘিরে এত আয়োজন কিন্তু তার কোনো খবর নেই।’
কিছুক্ষণ পর গেট দিয়ে তিনটা ছেলে ঢুকলো। সঙ্গে আছেন অপূর্ব, নাহিদ ও তিন্নি। রিমা ভ্রুকুটি করেছে। ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘অভ্র ভাই ছোট বেলায় খুব মোটা ছিল। এখন হয়তো স্লিম ফিট।’
বর্ষা হাসল। বলল,
‘সে এত মোটা ছিল যে হাঁটলেই পড়ে যেত।’
কথাগুলো বলার সাথে সাথেই বর্ষার চোখের সামনে টেবিলে শক্ত হাত রাখলো একজন। শব্দটা এতই জোরে হল যে বর্ষা চমকে গেল। তিন্নি এসে পাশেই দাঁড়ালো। অভ্র তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘এই বুনো মেয়ে এখানে কি করছে?’
তিন্নি বলল,
‘ওঁ তো..’
অভ্র তিন্নিকে থামিয়ে বলল,
‘ছোট চাচার একমাত্র মেয়ে। আর তার এই বন্য মেয়ে…’
অভ্র তার কথা শেষ করতে পারেনি। তার আগেই বৃষ্টি ছাড়া তার মুখে পানি পড়ল। টেবিলের উপর জলের জগ রাখা আছে। অভ্র বারবার তাকে বুনো বলে ডাকছে দেখে বর্ষা জগ ভরা পানি ছুড়ে দেয়। তিরস্কারের সুরে বলল তিন্নি,
‘বর্ষা। এটা কেমন অসভ্যতা।’
‘সে আমাকে বন্য বলে ডাকছে কেন।’
অভ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘গতকাল ওঁ আমার দিকে কাঁদা ছুঁড়েছিল আর এখন পানি আগে আমি এটা সম্পর্কে সবাইকে বলি।’
অভ্রর কথা শুনে বর্ষা চমকে গেল। তিন্নি বলল,
‘তোর উপর কাঁদা নিক্ষেপ করেছে ভাই?’
অভ্র বলল,
‘হ্যাঁ। গতকাল বিকেলে দেশে আসলছি। গ্রামে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তারপর দেখলাম সে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম তাকে বুঝিয়ে গাড়িতে নিয়ে বাসায় চলে আসব। আর সে আমার বুকে মাটি মারলো। সেই গন্ধ এখনো কাটেনি। এখন আবার পানি। ওঁ এত অভদ্র হল কিভাবে?’
তিন্নি বর্ষার দিকে তাকাল। সে ভ্রুকুটি করল।
রিমা জিজ্ঞেস করল,
‘তিন্নি আপু, উনি আমাদের?’
তিন্নি একবার রিমার দিকে তাকাল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘অভ্র ভাই।’
আনিসুল হকের মৃত দীঘি ঘাটে এসেছে বর্ষা। বাড়িতে যেতে ইতস্তত করছে, অভ্র ভাইয়ের সাথে অন্যায় করার জন্য তাকে বাড়িতে বকাঝকা শুনতে হবে। রিমা বলল,
‘ক্ষুধা লাগছে বাড়ি যাবি না – এখানেই বসে থাকবি?’
বর্ষা বলল,
‘অভ্র ভাই এতক্ষণে বাসায় সব বলে দিয়েছেন। আমি বাড়ি গেলে মা আর বাকিরা রাগ করবে।’
রিমা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘তুই তোর বারান্দার পাইপ বেয়ে রুমে যেতে পারিস তাহলে কেউ দেখবে না।’
‘পড়লে হাত পা ভাঙবে।’
রিমা চোখ সরু করে বলল,
‘এর আগে তোকে একদিন উঠতে দেখেছি।’
বর্ষাকে গম্ভীর দেখাচ্ছে। রিমা কিভাবে দেখল? সে খুব সাবধানে এবং সবার থেকে লুকিয়ে উঠেছিল। রিমা বর্ষার হাত ধরে টেনেটুনে বাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে গেল।
বর্ষার পাশের ঘরটা অভ্রের। দুটি ঘরের বারান্দা কাছাকাছি, একটি থেকে অন্যটিতে লাফিয়ে যাওয়া যায়। বর্ষা পাইপ দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে একটা পুরুষালি কণ্ঠ শুনতে পেল।
‘এই মেয়ে? ওখানে কি করছ?’
সাহিল গালে হাত দিয়ে ওদের দেখছে। পিন্চ মেরে বলল,
‘ভাই, তোর বোনেরা দেখছি বানর রে।’
সাহিলের দিকে রাগ করে তাকালো অভ্র। অভ্র খুব বুদ্ধিমান তাই তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি কেন বর্ষা পাইপ চড়ছে? শান্ত গলায় অভ্র বলল,
‘কাউকে কিছু বলিনি, প্রধান দরজা দিয়ে এসো।’
রিমা বর্ষার হাত ধরে বলল,
‘তাড়াতাড়ি চল।’
সকালের নাস্তার ব্যবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল অভ্র। বলল,
‘এত কিছু?’
মানোয়ারা বেগম বললেন,
‘দাদা ভাই, এখনও কিছু হয়নি। দুপুরে আরও সুস্বাদু খাবার রান্না হবে।’
অভ্র হাসলো। মা ও চাঁচিদের উদ্দেশ্য বলল,
‘তোমরা আজ আমার সাথে খেতে বসো। সবাই একসাথে খেতে বসলে ভালো লাগবে।’
অভ্রের মা আসিফা বেগম বললেন,
‘আমরা খেতে বসলে তোদের খাবার কে বাড়বে?’
অভ্র মৃদু হেসে বলল,
‘বর্ষা আর রিমা দেবে।’
রিমা একবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে বর্ষার দিকে তাকাল। বর্ষা বিড়বিড় করে বলল,
‘আমি বলেছিলাম না, আমার জাত শত্রু।’
রিমা বলল,
‘তোর জন্য আমাকেও ফাঁসতে হল।’
আসিফা বেগম বললেন,
‘ওঁরা কিভাবে কররে? ওঁরা এ কাজ কখনো করেনি।’
‘এ কাজ কখনও করেনি বলে কি করতে হবে না? বড় হয়েছে বিয়ে দিতে হবে তো।’
মা আর বড়আম্মুর কথা শুনে ওঁরা খাবার বাড়াতে লাগলো। বাড়িতে এই জিনিসগুলি ওরা আগে কখনও করেনি তবে কাজটি ঠিকঠাক করেই করছে। অভ্র গ্লাসের উপর দিয়ে তর্জনী চালাল। পেট ভরে হেসে বলল,
‘বর্ষা, এক বাটি ডাল দাও।’
বর্ষা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘দিচ্ছি।’
দুপুরে খাওয়ার পর ঘুম খুব ভালো হয়। পর্যাপ্ত ঘুম পেলে মন সতেজ থাকে। ঘুম পূর্ণ না হলে শরীর অলস হয়ে যায়। তখন আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না। শরীর নড়তে চায় না। পেটের উপর কিছু একটা বিড়বিড় করছে, বর্ষা ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে দেখল ইঁদুর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল। বিছানা থেকে নেমে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ইঁদুরটি কোথায় দৌঁড়ে গেছে তা দেখতে পেল না। বর্ষা বুকে হাত রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ভাগ্য ভালো কেউ দেখেনি। নইলে সবাই জানত আমি ইঁদুরকে ভয় পাই।’
অভ্র হেসে দরজায় হেলান দিয়ে আছে। তাকে দেখা মাত্রই বর্ষা তার কপালে চার ভাজ ফেলল। অভ্র একটু ঝুঁকে পড়ল। ফিসফিস করে বলল,
‘তুমি কি ইঁদুরকে ভয় পাও?’
বর্ষা শুকনো ঢোক গিলে খেয়েছে। শান্ত গলায় বলল,
‘না। আমি ইঁদুরদের ভয় দেখানোর জন্য চিৎকার করছিলাম। দেখুন অভ্র ভাই, ইঁদুর ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।’
অভ্র বাঁকা করে হাসল। তারপর সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অভ্র সিঁড়ি দিয়ে নামছে। পিছু পিছু বর্ষা এল। চিন্তিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
‘অভ্র ভাই।’
‘হুহ।’
বর্ষা এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আমাকে আগে থেকে চিনতেন?’
অভ্র তার মেরুদণ্ড শক্ত করে বলল,
‘হ্যাঁ। তিন্নি প্রায় সবার ছবি তুলে দিত।’
অভ্র দুটো সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল। বর্ষা বলল,
‘আমি আপনাকে চিনতে পারিনি অভ্র ভাই। আর আপনি পরিচয় দেননি কেন? শুধু ধমক দিচ্ছিলেন।’
অভ্র ঘুরে তাকাল। নরম গলায় বলল,
‘তোমার আমাকে দেখা বা চেনার দরকার পড়েনি, আমার দরকার পড়েছিল তাই তিন্নির কাছে সবার ছবি চেয়েছিলাম। আমার ছোট ভাই বোনেরা কত বড় হয়েছে তা দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তোমাদের তা ছিল না। আর আমি তোমার বড় ভাই তোমাকে শাসন করার অধিকার আছে। তাছাড়া আমি আমার পরিচয় দেওয়ার সময় দেইনি। গাড়ির হেডলাইটে তোমার মুখ যখন দেখি ততক্ষণে তুমি কাঁদা ছুঁড়ে পালিয়ে গেছ।’
বর্ষা ঠোঁট উল্টিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
অপূর্ব আর তিন্নি ড্রয়িংরুমে বসে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছে। অভ্র গিয়ে তাদের পাশে বসল। নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘গত আট বছরে দেশে এবং গ্রামে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তুই যদি গ্রামটি ঘুরে দেখতে চাস তবে আমরা বাইরে যাওয়ার প্ল্যান চালিয়ে যাব।’
অভ্র ভ্রুকুটি করল।
‘কোথায় যাবি?’
‘কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। আমি যতদূর যেতে পারি গাড়ি নিয়ে যাব।’
অভ্র কপালে শাহাদাত আঙুল রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কোন বিশেষ জায়গা নেই।’
তিন্নি বলল,
‘অনেক জায়গা আছে। একটা জায়গার নাম বললে সেথায় আর যাওয়া হবে না তাই উদ্দেশ্যহীনভাবে বের হব।’
অভ্র রাজি হল। বাড়িতে বসে থাকতে তারও একটু বিরক্ত লাগছে। সবাই একসাথে বাইরে যেতে ভালো লাগবে। তিন্নি বলল,
‘বর্ষা তুই আর রিমা সময়মতো রেডি হয়ে যাবি। যদি দেরি হয়, তোদের রেখে আমরা চলে যাব।’
অভ্র বর্ষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আমরা কি শিশু পার্কে যাচ্ছি?’
অপূর্ব ভ্রু তুলল। বলল,
‘না। কেন?’
অভ্র সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
‘তাহলে ওদের বলছিস কেন? তারা তো শিশু।’
বর্ষা বিরক্ত গলায় বলল,
‘কোন দিক থেকে আমাকে শিশু মনে হয়?’
অভ্র হেসে বলল,
‘সব দিক থেকে।’
অপূর্ব বলল,
‘বর্ষা ওকে পাত্তা দিস না। অভ্র মজা নিচ্ছে। তুই তিনটার আগে রেডি হয়ে যাবি।’
বর্ষা চলে গেল। অভ্রের উদ্দেশ্য নাহিদ বলবল,
‘তুই ওঁর পিছু পড়েছিস কেন?’
অভ্র একটা মুচকি হেসে বলল,
‘যারা কথায় কথায় রেগে যায় তাদের রাগাতে অনেক মজা।’
বর্ষা মায়ের কাছ থেকে একটা সাদা শাড়ি নিয়ে এসেছে। আঁচল মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছে, কোমর পর্যন্ত চুল খোলা রেখে হালকা সেজে নিল। বাড়ির সামনে গাড়ি অপেক্ষা করছে, রিমা বর্ষাকে ডাকতে এল,
‘তাড়াতাড়ি চল তিন্নি আপু ডাকছে। আরেকটু দেরি হলে চলে যাবে।’
বর্ষা রিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার হয়ে গেছে, চল।’
রিমা চোখ মেলে বলল,
‘তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। যদি কেউ নজর লাগিয়ে দেয়? দাঁড়া, কানের পেছনে একটা কালো ফোঁটা দিয়ে দেই।’
বর্ষা রিমাকে থামিয়ে বলল,
‘মার খেতে চাস?’
রিমা জোরে হেসে উঠল।
মকসবিল মাজুখান এসে গাড়ি থেকে নেমে যায়। বিলটির অবস্থান গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক ও মধ্যপাড়া ইউনিয়নে। মকস বিলে, ষোলহাটি, তালতলী, হাটুরিয়াচালা এলাকা ও তুরাগ নদীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের নিয়ে শত শত নৌকা, মোটর বোট, মিনি বোট চলাচল করে। সবচেয়ে বড় এই বিলের বুকে রঙিন নৌকায় ভরে আছে। বর্ষা সাঁতার জানে না তাই সে নৌকায় উঠবে না। বড় ভাই-বোন আর ছোটরা একটা নৌকা দেখে উঠে পড়ল। নৌকা মনে হয় বিলের মাঝখানে চলে গেছে।
জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। ঠোঁট উল্টিয়ে একবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর পুরুষটাকে দেখল তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘অভ্র ভাই।’
অভ্র উত্তর দিল না। সে বর্ষার দিকে ফিরে তাকাল। বর্ষা একটু সময় নিয়ে বলল,
‘আপনি ওদের সাথে যাননি কেন?’
অভ্র অস্ফুট জবাব দিল,
‘অনেক ছেলে এখানে বেড়াতে আসছে। সবাই তোমাকে একা রেখে চলে গেলে তারা বিরক্ত করতে পারে। আমি এই ঝুঁকি নিতে চাই না।’
বর্ষা বলল,
‘শুধু তার জন্য?’
‘হুম।’
অভ্র জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। বর্ষার দিকে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
‘শাড়ি পরে এসেছ কেন?’
বর্ষা তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘কেন?’
অভ্র আশেপাশে কিছু লোক দেখিয়ে বলল,
‘তুমি শাড়ি পরেছো বলে ওরা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। শাড়িতে মেয়েরা সহজেই পুরুষের নজরে আসে।’
বর্ষা এদিক ওদিক তাকায় তারপর মাথা নিচু করে। অভ্র তার জ্যাকেট খুলে বর্ষার কাঁধে রাখল। ঠিক করে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘শাড়ি পরে আর বের হবে না।’
বর্ষা ডান দিকে মাথা নাড়ল। এর অর্থ, ঠিক আছে।
নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল অভ্র,
‘কিছু খাবে?’
‘আইসক্রিম।’ বর্ষা হাসিমুখে জবাব দিল।
অভ্র দুটো আইসক্রিম এনে বর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিল। বর্ষা খুশিতে হাসল। মৃদুস্বরে বলল অভ্র,
‘আইসক্রিম খুব বেশি পছন্দ?’
‘হ্যাঁ।’
নানা রকম ফুলের গাছ, প্রতিটি গাছে ফুল ফুটেছে। সকালে এবং সন্ধ্যায় গাছগুলিকে নিয়মিত জল দেওয়া হয়। বর্ষা ঝাঁঝরি নিয়ে গাছে পানি দিতে লাগল। অভ্র এসে পাশে দাঁড়াল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘ফুলের বাগান কে করেছে?’
‘আমি।’
অভ্র ইতস্তত করে একটু সময় পর বলল,
‘ওহ। এটা নে। ধর।’
বর্ষা না তাকিয়ে বলল,
‘কি?’
‘আইসক্রিম। সবার জন্য আনা হয়েছে। আর এটা তোর।’
বর্ষার হাত ভিজে গেছে। সে বলল,
‘আমার হাতে কাঁদা লেগে আছে।’
অভ্র বলল,
‘আমি ফ্রিজে রাখছি। মনে করে খাবি।’
‘আচ্ছা।’
বর্ষা হাত মুখ ধুয়ে রুমে এলো। বিছানায় আরাম করে বসে ফোন স্ক্রল করছে। হঠাৎ আইসক্রিমের কথা ভেবে সে নিচে নেমে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রিজে আইসক্রিম নেই। বর্ষা ভালো করে খুঁজেও পেল না। তখন দেখল তার বড় বোন মুন্নি আইসক্রিম খেতে খেতে এগিয়ে আসছে। বর্ষা তাকে ডেকে বলল,
‘এই আপু আইসক্রিম কোথায় পেয়েছ?’
মুন্নি বলল,
‘এটা ফ্রিজে ছিল।’
বর্ষা আসিফা বেগমের উদ্দেশ্য বলল,
‘ও বড় মা, তোমার মেয়ে আমার আইসক্রিম খাচ্ছে।’
মুন্নি বলল,
‘এটা কি তোর ছিল? আমি জানতাম না। এখন কাঁদিস না, আমি তোকে আরেকটা এনে দেবো।’
তিন্নি বলল,
‘এখানে কি হচ্ছে? আর তোর পড়ালেখা নেই?’
বর্ষা কর্কশ গলায় বলল,
‘মুন্নি আপু আমার আইসক্রিম খাচ্ছে। সে আমারটা খাবে কেন?’
তিন্নি বলল,
‘ভুল করে খেয়ে ফেলছে। তুই এখন পড়তে যা। আমি অপূর্বকে দিয়ে তোর জন্য দুটো আইসক্রিম আনিয়ে রাখব।’
বর্ষা রাগী গলায় বলল,
‘একটাও লাগবে না।’
বর্ষা চলে গেছে। তিন্নি মুন্নির উদ্দেশ্য বলল,
‘তুই কি ছোট? ওঁর আইসক্রিম খেতে হবে কেন?’
মুন্নি অপরাধীর কণ্ঠে বলল,
‘আমি জানতাম না যে আইসক্রিম বর্ষার ভেবেছিলাম একটা বেশি হয়েছে বলে ফ্রিজে রেখেছে।’
রাত ৮টা। বাড়ির সবাই খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে। অভ্র এখনো নামছে না। পাপিয়া বেগম বললেন,
‘বর্ষা।’
‘হ্যাঁ মা।’
‘অভ্রকে ডেকে নিয়ে আয়। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলেটা এত দেরি করছে কেন?’
‘যাচ্ছি।’
বর্ষা অভ্রর ঘরের ভেজানো দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে বলল,
‘অভ্র ভাই আসবো?’
ভেতর থেকে একটা আওয়াজ এল,
‘কি চাই?’
‘সবাই রাতের খাবার টেবিলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’
অভ্র চমকে উঠল।
‘এত তাড়াতাড়ি ডিনার?’
অভ্র আবার বলল,
‘বর্ষা ভেতর আয়। তোর জন্য আমার থেকে একটা উপহার আছে।’
বর্ষা খুশি হয়ে ঘরে ঢুকল। অভ্র বাড়ির সবার জন্য যে উপহার নিয়ে এসেছিল সকালে তাদের দিয়েছে। শুধু বর্ষাকে দেয়নি। সে বলেছিল ওটা অন্য ব্যাগে আছে, বের করে পরে দেবে। বর্ষা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। অভ্র বলল,
‘চোখ বন্ধ কর। তারপর হাতটা এগিয়ে দে।’
বর্ষা তাই করে। অভ্র হাসলো। তারপর বলল,
‘চোখ খোল।’
বর্ষা অবাক হল। রান্নার পাত্র, চপস্টিক, কারি চামচ, কাটা চামচ সহ একটি বাক্স। বর্ষা হতভম্ব চোখে অভ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এগুলো কী?’
অভ্র বিছানায় বসল। সে পায়ের উপর পা তুলে বলল,
‘আমি তোর জন্য এগুলো কিনেছি কারণ তুই ঘরের কোনো কাজ পারিস না। কাল থেকে রান্না করবি, এগুলো কাজে লাগবে।’
বর্ষা রেগে বাক্সটা বিছানায় রাখল। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
‘অভ্র ভাই, আপনি খুব খারাপ। আমার এই সব দরকার নেই।’
খাওয়া শেষ করে দাদার কক্ষে গেল। নূর ইসলাম আজকাল বেশি অসুস্থ থাকেন এবং তিনি মৃত্যুর আগে তার স্ত্রীকে নিয়ে হজ করতে চান। তার তিন ছেলে বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। বড়জন বললেন,
‘আমি সব ব্যবস্থা করছি। আর পাসপোর্টের জন্য একবার তোমাদের চৌরাস্তা যেতে হবে।’
অভ্র বলল,
‘দাদা-দাদী একা যাবে কী করে? দাদার শরীর ভালো থাকে না।’
অপূর্ব বলল,
‘আমি তাদের সাথে যাব।’
বর্ষা যখন রুমে এল তখন রাত দশটা। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে পিছন ফিরতেই বর্ষা অবাক হয়ে গেল। বিছানায় একটি উপহার বাক্স রাখা। দরজা ছিটকানি দিয়ে বাক্সটা হাতে নিয়ে কোলে রাখল। তারপর বাক্সটি খুলল, বর্ষার চোখের সামনে প্রথম যে জিনিসটি ভেসে উঠল তা হল ছোট অক্ষরে লেখা একটি নোট –
‘তিন্নির মুখ থেকে শুনেছি তুই সাদা শাড়ি খুব পছন্দ করিস। তোর জন্য এই শাড়িটা কিনতে দুদিন সময় লেগেছে।’
চিরকুটটা একপাশে রেখে বাক্স থেকে শাড়িটা বের করল বর্ষা। তারপর শাড়িটা কাঁধে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়াল। প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করল তাকে কেমন লাগছে। দুর্বোধ্য হাসির রেখা ফুটে ওঠে গালে।
‘পছন্দ হয়েছে?’
বর্ষা পুরুষ কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখল অভ্র দরজায় হেলান দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা ভ্রুকুটি করল। জিজ্ঞাসা করে,
‘অভ্র ভাই এখানে এলেন কী করে?’
অভ্র বলল,
‘বারান্দায় ঝাঁপ দিয়ে।’
বর্ষা হেসে বলল,
‘যদি পড়ে যেতেন?’
‘আমি? উঁহু, পড়ব না। শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
বর্ষা মুচকি হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, খুব।’
সকালবেলা। সূর্যের সোনালী রশ্মি পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্নিগ্ধ সকাল বর্ষার ভালো লাগে। সে প্রতিদিন ফজরের পর বারান্দায় আসে। কখনো একটু হাঁটে আবার কখনো চেয়ার টেনে বসে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, পাতা দুলছে মৃদু বাতাসে। গাছের ডালে বসে এক ঝাঁক পাখি মিষ্টি গলায় ডাকছে। বর্ষা আজ জানালার পাশে বসে আছে। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না। কারণ ছাড়া, হুটহাট ভালো লাগে না এটা তার নিজেরও পছন্দ না। সহসা রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গুনগুন করে গান ধরল,
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
অভ্র তাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। সহসা বিড়বিড় করে বলল,
‘ফাটা বাঁশ।’
বর্ষা অভ্রর পিছু নিল। অভ্র কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে। হঠাৎ পিছন ফিরে দেখল বর্ষা অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র হাঁটতে লাগল। বর্ষা তার পিছনে দৌঁড়ে গেল। আওয়াজ তুলে বলল,
‘অভ্র ভাই।’
অভ্র তাকালো না। উচ্চস্বরে বলল,
‘কি?’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বিলে।’
‘আমিও যাব।’
‘না।’
‘একটু যাই না অভ্র ভাই।’
‘ওখানে মেয়েদের কোনো কাজ নেই।’
এত অনুরোধের পর অভ্র বর্ষাকে রেখে আসতে পারেনি। তারা একসাথে হাঁটা শুরু করল। বর্ষা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল ভোরবেলা বাইরে অনেকেই হাঁটছে। কেউ কেউ নদীর পাড়ে বসে গল্প করছে। আর বিলে মানুষের আনাগোনা তেমন নেই। বর্ষা হঠাৎ বলে উঠল,
‘অভ্র ভাই একদিন কি হয়েছিল জানেন?’
অভ্র মন্ত্রমুগ্ধ চোখে তাকাল। জিজ্ঞাসা করল,
‘কী হয়েছে?’
বর্ষা জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। খুশিতে বলল,
‘এক মাস আগে একদিন আইসক্রিম কিনতে দোকানে গিয়েছিলাম। তখন একজন লোক এসে দোকানদারের কাছে পাইলট চাইল। আমি খুব অবাক, পাইলট বিমান থেকে দোকানে আসবে কী করে? আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম আর দোকানদার বলল, হ্যাঁ আছে। তারপর একটা সিগারেট বের করল। সিগারেটের প্যাকেটে বড় অক্ষরে লেখা ছিল পাইলট।’
কথা শেষ করে বর্ষা জোরে জোরে হাসতে লাগল। অভ্র হঠাৎ বর্ষার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
‘আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিলি না-কি সিগারেট নিয়ে গবেষণা করতে?’
বর্ষা মৃদু হেসে বলল,
‘আইসক্রিম কিনতে। আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
অভ্র প্রকৃতির শান্ত পরিবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘হু, কর।’
বর্ষা অভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘অভ্র ভাই, আপনি সিগারেট খান না?’
মৃদুস্বরে বলল অভ্র,
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি সিগারেটের বাজে গন্ধ পছন্দ করি না।’